শূন্যতা সৃষ্টি করে এক মহীরুহের বিদায়
নূর হোসাইন কাসেমী রহ.—এর ইন্তেকাল
মাওলানা শিব্বীর আহমদ
১৩ ডিসেম্বর ২০২০। জোহরের নামাযের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিলাম। এমন সময় শুনতে পেলাম হযরত মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী রহ.—এর মৃত্যুসংবাদ। ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিঊন।
اَللّٰهُمَّ اغْفِرْ لَهُ وَارْحَمْهُ وَعَافِهِ وَاعْفُ عَنْهُ وَاَكْرِمْ نُزُلَهُ وَوَسِّعْ مُدْخَلَهُ وَاغْسِلْهُ بِالْمَاءِ وَالثَّلْجِ وَالْبَرَدِ وَنَقِّهِ مِنَ الْخَطَايَا كَمَا نَقَّيْتَ الثَّوْبَ الْاَبْيَضَ مِنَ الدَّنَسِ وَاَبْدِلْهُ دَارًا خَيْرًا مِنْ دَارِهِ وَاَهْلاً خَيْرًا مِنْ اَهْلِهِ وَزَوْجًا خَيْرًا مِنْ زَوْجِهِ وَاَدْخِلْهُ الْجَنَّةَ وَاَعِذْهُ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ
হে আল্লাহ, আপনি তাকে ক্ষমা করে দিন। তাকে দয়া করুন। তাকে নিরাপদ রাখুন। তাকে মাফ করুন। তার জন্যে সুন্দর আপ্যায়নের ব্যবস্থা করুন। তার থাকার জায়গাটি প্রশস্ত করে দিন। তাকে পানি শিলা ও বরফ দিয়ে ধুয়ে দিন। সাদা কাপড়কে যেভাবে ময়লামুক্ত করা হয় তাকে সেভাবে পাপ থেকে মুক্ত করে দিন। তাকে এ বাড়ির পরিবর্তে আরও উত্তম বাড়ি দান করুন। এখানকার পরিবার—পরিজনের পরিবর্তে আরও উত্তম পরিজন দান করুন। এখানকার জীবনসঙ্গীর তুলনায় আরও উত্তম জীবনসঙ্গী দান করুন। তাকে বেহেশতে প্রবেশ করান এবং কবরের আযাব থেকে তাকে রক্ষা করুন।
হযরত মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী রহ.—কে কী বলে উল্লেখ করব! তিনি ছিলেন আমাদের চেতনার মিনার, শত—সহস্র আলেম—ওলামার মুরব্বী। ছিলেন বর্ষীয়ান আলেমে দ্বীন, আধ্যাত্মিক রাহবার, সংগঠক, রাজনীতিক, অন্যায়ের প্রতিবাদকারী, অকুতোভয় সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব। এসব ছাপিয়ে তাঁর বড় পরিচয়—তিনি ছিলেন একজন গুণী শিক্ষক। মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিন দশকেরও বেশি সময়। তার ইন্তেকালের পর সকলের মুখে মুখে শোনা যাচ্ছে—তিনি ছিলেন ছাত্র গড়ার কারিগর।
মাওলানা কাসেমী রহ.—এর বয়স হয়েছিল ৭৫। ১৯৪৫ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মস্থান কুমিল্লা জেলার মনোহরগঞ্জ থানার চড্ডা নামক গ্রাম। ছিলেন মেধাবী, প্রতিভাবান। প্রাথমিক শিক্ষার বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে বাবার আন্তরিক ইচ্ছায় তিনি পড়তে যান আলোর মিনার দারুল উলূম দেওবন্দে। কিন্তু যখন তিনি দেওবন্দে পৌঁছেন, তখন সেখানে ভর্তির সময় শেষ। ফলে সে বছর সেখানকার অন্য একটি মাদরাসায় ভর্তি হন। পরের বছর চলে আসেন স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম দেওবন্দে। সেখান থেকে দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করেন। বুখারী শরীফের পাঠ গ্রহণ করেন সেকালের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস মাওলানা ফখরুদ্দীন মুরাদাবাদী রহ.—এর কাছে। তাঁর একান্ত স্নেহভাজন হিসেবেও তিনি সকলের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন। দাওরায়ে হাদীস শেষ করার পর তিনি সেখানে আরও তিন বছর উচ্চতর শিক্ষার্জন করেন। মাওলানা মুরাদাবাদী রহ. ছাড়াও তার শিক্ষকদের মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য—মাওলানা ওয়াহীদুযযামান কিরানবী, মাওলানা কারী মুহাম্মদ তায়্যিব, শায়খুল হাদীস যাকারিয়া কান্ধলভী, মুফতী মাহমুদ হাসান গঙ্গোহী, মাওলানা শরীফুল হাসান, মাওলানা নাসির খান, মাওলানা সালেম কাসেমী, মাওলানা সাঈদ আহমদ পালনপুরী রহিমাহুমুল্লাহ।
প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষ করে তিনি ভারতের মুজাফফরনগরে অবস্থিত মুরাদিয়া মাদরাসায় এক বছর শিক্ষকতা করেন। এ মাদরাসাটিও হুজ্জাতুল ইসলাম কাসেম নানুতুবী রহ. কতৃর্ক প্রতিষ্ঠিত। সেখান থেকে দেশে ফিরে আসেন ১৯৭৩ সালে। শুরুতেই শরিয়তপুরের নন্দনসার মুহিউস সুন্নাহ মাদরাসার মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস পদে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৮ সালে চলে আসেন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান ফরিদাবাদ মাদরাসায়। চার বছর এখানে শিক্ষকতার পর নতুন কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেন জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগকে। এখানে ছিলেন ৬ বছর।
১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা। অবশিষ্ট জীবন তিনি এ মাদরাসার মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস হিসেবেই কাটিয়ে দেন। অবশ্য নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে তাকে চলে যেতে হয়েছিল এ প্রতিষ্ঠান ছেড়ে। তখন গড়ে তোলেন আরেক প্রতিষ্ঠান—জামিয়া সুবহানিয়া ধওর।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর তিনি আবারও ফিরে আসেন বারিধারায়। এরপর থেকে দুটি প্রতিষ্ঠানই একসঙ্গে চলতে থাকে তার তত্ত্বাবধানে। অবশেষে জামিয়া সুবহানিয়ার গোরস্থানই হয় তার শেষ বিছানা।
কর্মমুখর এ ছোট জীবনে রাজনীতির সঙ্গেও তিনি ছিলেন সক্রিয়। ১৯৭৫ সাল থেকেই জুড়ে ছিলেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সঙ্গে। ১৯৯০ সালে চলে আসেন জমিয়তের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে। ২০১৫ সাল থেকে ছিলেন মহাসচিব।
২০১৩ সালে এক চরম সংকট মুহূর্তে চট্টগ্রামের হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ যখন জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসে, তখন থেকেই তিনি ছিলেন এ সংগঠনের নায়েবে আমীর এবং ঢাকা মহানগরীর সভাপতি। মাস তিনেক আগে হেফাজতের আমির শায়খুল ইসলাম মাওলানা শাহ আহমদ শফী রহ.—এর মৃত্যুর পর কেন্দ্রীয় মহাসচিব মনোনীত হন। আমাদের কওমী মাদরাসাসমূহের সবচেয়ে বড় শিক্ষাবোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন বহু বছর। জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি বেফাকের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। তাঁর ইন্তেকালের মধ্য দিয়ে আমরা তাই হারিয়েছি জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা ও জামিয়া সুবহানিয়ার মুহতামিম, এ দুটিসহ আরও অনেক মাদরাসার শায়খুল হাদীস, হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার সিনিয়র সহ—সভাপতি, আলহাইয়াতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়ার কো—চেয়ারম্যান এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিবকে।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকে কাদিয়ানিবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তিনি ছিলেন তখন খতমে নবুওয়ত আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক। এরপর খতমে নবুওয়ত আন্দোলন অনেকটাই স্তিমিত হয়ে গেছে, কিন্তু স্তিমিত হয়নি মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী রহ.—এর কণ্ঠ। ইসলাম, দেশ, জাতি, সমাজের যেকোনো সংকটে তিনি সামনে এসেছেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইসলাম টাইমস২৪.কম—এ প্রকাশিত কয়েকটি শিরোনাম লক্ষ করুন—আলেমদের সঙ্গে সংঘাতে জড়াতে সরকারকে প্ররোচিত করা হচ্ছে : আল্লামা কাসেমী [৯.১২.২০২০], এসএসসিতে ইসলামী শিক্ষা বাদ দেওয়ার হঠকারী সিদ্ধান্ত জাতি মেনে নেবে না : মাওলানা কাসেমী [১.১২.২০২০], বাবরি মসজিদ রায়ে ভারতের আদালত বিচারের নামে তামাশা করেছে : মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী [১.১০.২০২০], ইউরোপে কোরআন অবমাননা, নিজেদের সভ্য দাবি করা তাদের ভণ্ডামি ছাড়া কিছু নয় : আল্লামা কাসেমী [১.৯.২০২০], সীমান্তে বিএসএফ কতৃর্ক বাংলাদেশী খুনের নিন্দা জানালেন আল্লামা কাসেমী [২৫.৬.২০২০], বিদ্যুতে গ্রাহক ভোগান্তি চরমে, ভতুর্কিতে পকেট ভারী ব্যবসায়ীদের : আল্লামা কাসেমী [৫.৬.২০২০], করোনা : শরীয়া নির্দেশিত পন্থায় মুসলমানদের লাশ দাফনের আহ্বান নূর হোসাইন কাসেমীর [২৪.৩.২০২০], ইসকনকে মেলায় স্টল দেওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী [৪.২.২০২০], সম্পদে কোরআনে নির্ধারিত সুবিচার জরুরি, সমতা নয় : আল্লামা কাসেমী [১.৫.২০১৯], ভারত—পাকিস্তান যুদ্ধন্মুখ উত্তেজনায় আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমীর উদ্বেগ [১.৩.২০১৯], গার্মেন্ট শ্রমিকদের ন্যায্য দাবিদাওয়া মেনে নেওয়ার আহ্বান নূর হোসাইন কাসেমীর [৯.১.২০১৯], হেফাজত ইস্যুতে অসত্য বলে তাওহিদি জনতার হৃদয়ে ব্যথা দিবেন না : আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী [৫.১১.২০১৮], ধর্ম যার যার, উৎসব সবার—উক্তিটি ইসলামবিরোধী : আল্লামা কাসেমী [১৬.১০.২০১৮]। এ ধরনের শিরোনাম লেখা যাবে আরও অনেক।
আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী রহ.—এর কাছে প্রথাগত পাঠগ্রহণের সুযোগ আমার হয়নি। তবে মাদরাসায় পড়াশোনাকালে হেফজখানার গণ্ডি পেরিয়ে যখন কিতাবখানায় ভর্তি হই, তখন থেকে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার শেষ পর্যন্ত যাদের কাছে পড়েছি, যাদের পাঠদান মুগ্ধতার সঙ্গে উপভোগ করেছি, যাদের সামনে ছাত্র হিসেবে বসতে পারাকে নিজের জীবনের সৌভাগ্য ও বড় প্রাপ্তি মনে করি—তাদের অধিকাংশই আল্লামা কাসেমীর একান্ত শিষ্য। আমার এ পর্বের শুরুটা হয়েছিল উত্তরার বাইতুস সালাম মাদরাসা থেকে। এরপর তেঁজগাওয়ের জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়ায় এসে শেষ।
বাইতুস সালামের মুহাদ্দিস মাওলানা খন্দকার মনসুর আহমদ, জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়ার শায়েখ মাওলানা আবদুল মতিন, শায়খুল হাদীস মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম, শায়েখে সানী মাওলানা আবদুল গাফফার, জামিয়ার সাবেক মুহতামিম মুফতী মোহাম্মদ আলী, সাবেক নাযেমে তালিমাত মাওলানা মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন, সাবেক মুহাদ্দিস মুফতী বুরহানুদ্দীন—তারা মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী রহ.—এর শিষ্য, খুবই ঘনিষ্ঠ শিষ্য এবং আমার উস্তায। সরাসরি যদিও কাসেমী রহ.—এর কাছে পাঠগ্রহণের সুযোগ হয়নি, কিন্তু তাঁদের মুখে নানান প্রসঙ্গে নানা প্রেক্ষিতে কতবার যে শুনেছি তাদের প্রিয় এ শিক্ষকের কথা! অবশ্য ছাত্রত্বের জন্যে যদি অধিক পরিমাণে পাঠগ্রহণ আবশ্যক না হয়, তবে আমিও তার ছাত্র—এ কথা বলতে পারি। নিয়মিত তিনি যেসব মাদরাসায় পড়াতেন, সেখানে হয়তো পড়িনি, কিন্তু তার ইফতেতাহে বুখারী ও খতমে বুখারীর দরসে তো বসেছি। ছাত্র হওয়ার নিয়তেই বসেছি।
আমরা যারা বাইরে থেকে তাকে দেখেছি, দেখেছি সদাকর্মচঞ্চল এক বীরপুরুষ। হকের বিষয়ে তিনি সদা আপসহীন। একজন জামায়াতে ইসলামির সমর্থক ইন্তেকাল করেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। দুআ করি, আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন, তার ভুলভ্রান্তিগুলো ক্ষমা করে দিন। তার মুখে দুটি নাম প্রায়ই শুনতাম—শামসুদ্দীন কাসেমী আর নূর হোসাইন কাসেমী। তারা দুজনই ছিলেন জামায়াতে ইসলামির বিরুদ্ধে বেশ সোচ্চার। যেটাকে অন্যায় মনে করেছেন, আমরা দেখেছি, সারা জীবনই তিনি সে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে গেছেন। চেতনার প্রশ্নে কারও সঙ্গেই আপস করেননি।
তার কাছে যদিও সরাসরি পড়িনি, কিন্তু ছাত্রত্ব ও শিক্ষকতা—উভয় কালেই তার নাম শুনে শুনেই আমরা বড় হয়েছি। তার সম্পর্কে লিখতে গিয়ে কত কথাই এখন মনে পড়ছে। আবার হারিয়েও যাচ্ছে। গত শিক্ষাবর্ষের শুরুর কথা। আমাদের পার্শ¦বর্তী গ্রামের দক্ষিণ মির্জানগর হাফিজিয়া মাদরাসায় (বর্তমান নাম—জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া দক্ষিণ মির্জানগর) নতুন দাওরায়ে হাদীস খোলা হয়েছে। ইফতিতাহি মজলিসে হুযুর প্রধান অতিথি। গ্রামের মাদরাসা। আবার প্রথম বছরের দাওরায়ে হাদীস। আয়োজনটা তাই বড়ই ছিল। হুযুর এসেছেন, পড়িয়েছেন, বয়ান করেছেন। এরপর বিদায় নিয়েছেন। দুপুর গড়িয়ে তখন প্রায় বিকাল। অবাক হয়েছি যখন শুনেছি, এটি ছিল হুযুরের ওইদিনের পঞ্চম প্রোগ্রাম। তবে তাও শেষ নয়। এরপর আরও তিনটি ইফতিতাহের প্রোগ্রাম শেষ করে রাতে বারিধারা ফিরবেন। এ বৃদ্ধ বয়সে একজন ব্যস্ত মানুষ কীভাবে নানাজনের আবদার রক্ষা করতে পারেন—বিষয়টি সত্যিই অবাককরা।
২০০৬—০৭ সালের কথা। সদ্য প্রতিষ্ঠিত জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়ায় আমি মিশকাত জামাতে পড়ি। একদিন আল্লামা কাসেমী রহ. মাদরাসায় এলেন। ছাত্রদের মজলিসে হুযুর কথা বলবেন। তখন কোনো মেহমান এলে সাধারণত তাকে পরিচয় করিয়ে দিতেন মাদরাসার তখনকার মুহতামিম মুফতী মোহাম্মদ আলী দা.বা.। কিন্তু সেদিন তিনি অতিথি আল্লামা কাসেমীর পরিচয় নিজে না করিয়ে দিয়ে মাওলানা আবুল বাশার সাইফুল ইসলাম সাহেব হুযুরের নাম ঘোষণা করলেন—ছাত্রদের সামনে তিনি হুযুরের পরিচয় তুলে ধরবেন। হুযুর দাঁড়িয়েছেন। আল্লামা কাসেমী রহ. পাশে উপবিষ্ট। আমরা তাকিয়ে আছি উৎসুক দৃষ্টিতে। মাওলানা আবুল বাশার সাহেব হুযুর হামদ—সালাত পাঠ করলেন। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলেন। চোখ বেয়ে পানি ঝরে পড়ল। কিছু বলতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। অবশেষে এ কথাটুকু বলে বসে পড়লেন—এভাবে কথা বলা সম্ভব নয়। আমরা তাকিয়ে রইলাম। একজন মানুষের প্রতি কতটা মুগ্ধতা ও কৃতজ্ঞতা থাকলে অনুভূতির প্রকাশ এভাবে হতে পারে!
আমরা বলে এসেছি, সবকিছু ছাপিয়ে হুযুরের বড় পরিচয়—তিনি ছিলেন ছাত্র গড়ার কারিগর। এ লেখা প্রস্তুত করতে গিয়ে আমি এ বিষয়ে নতুন করে জানতে চেয়েছিলাম আমার দুইজন উস্তায মাওলানা আবদুল মতিন এবং মাওলানা খন্দকার মনসুর আহমদ—এর কাছে। পুরোনো শোনা কথাগুলোই আজকে আবার নতুন করে শুনলাম। তাঁর বৈশিষ্ট্য ছিল—তিনি ছাত্রদের হিম্মত জোগাতেন। সুউচ্চ মনোবলের অধিকারী করে তুলতেন। দরসে বিভিন্ন প্রসঙ্গে ছাত্রদের সাহস দিতেন। এগিয়ে চলার পথ দেখাতেন। কখনো ছাত্রদের একত্র করে ভাষণ দিতেন। কখনো আবার বিশেষ কাউকে ডেকে কথা বলতেন, মনের সাহস বাড়িয়ে দিতেন। তিনি বলতেন—হতাশা যেন কোনো অবস্থাতেই তোমার কাছে না আসে। তাঁর উদ্ধৃতিতে একটি কথা অনেক শুনেছি—‘হিম্মতের নাম ইসমে আযম’। একটি কথা এখনো কানে বাজে। ছাত্রদের এক মজলিসে মাওলানা যাইনুল আবিদীন সাহেব বলেছিলেন, মাওলানা কাসেমী রহ. বলতেন—কে বলেছে তুমি হুসাইন আহমদ মাদানী হতে পারবে না? কে বলেছে তুমি আশরাফ আলী থানভী হতে পারবে না? … হিম্মত ও সাহস জোগানোর জন্যে আর কী প্রয়োজন!
ছাত্রদের সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট খোঁজ রাখতেন। কোনো ছাত্র অনুপস্থিত থাকলে তার সম্পর্কে খোঁজখবর নিতেন। তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করতেন। ছাত্রদের ডেকে ডেকে কিতাব পড়তে দিতেন। কখনো নির্দিষ্ট কোনো প্যারা দেখিয়ে বলতেন—এটা পড়ে ফেলো। পরামর্শ দিতেন। নিজের কিতাব ছাত্রদের পড়তে দিয়ে অনেক কিতাব তার হারিয়েও গেছে। তবুও তিনি তাঁর মতোই চলেছেন। ছাত্রের ভবিষ্যত গড়ার চিন্তায় নিজে বিসর্জনের পথে এগিয়েছেন।
তিনি বারবার বলতেন, কিতাবের ইবারত থেকে কিতাব ‘হল’ করতে হবে। বুঝে নিতে হবে। ইবারত বোঝার জন্যে কোনো নোট বা শরাহ পড়তে অনুৎসাহিত করতেন। আবার দরসের আলোচনা শেষে ছাত্ররা যেন এর ওপর ভরসা করে না বসে, সেদিকেও তিনি সতর্ক করতেন। আলোচনা শোনার পাশাপাশি তারা যেন মূল উৎসগ্রন্থ থেকে বিষয়টা পড়ে নেয়—তা বলতেন। যাদের কাছে আমরা পড়েছি, যাদের কাছে হুযুরের কথা শুনেছি, তারা যখন ছাত্র, তখনকার বাংলাদেশে ছাত্রদের হাতে হাতে এখনকার মতো এত কিতাব ছিল না। সংকট ছিল কিতাব প্রাপ্তি এবং কেনার সামর্থ্য—উভয় দিক থেকেই। হুযুর নিজের কিতাবই ছাত্রদের দিয়ে দিতেন। কতটুকু পড়তে হবে—দেখিয়ে দিতেন। এভাবেই তিনি ছাত্রদেরকে কিতাবমুখী করে তুলতেন, তাদের মেহনতের অভ্যাস গড়ে দিতেন। আমাদের সৌভাগ্য, তার ছাত্রদের কাছে পাঠগ্রহণের সুবাদে এভাবে পড়ার কিছুটা সুযোগ আমরাও পেয়েছি।
ছাত্রদের প্রতি তিনি কতটা আন্তরিক ছিলেন, তার দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে মাওলানা আবদুল মতিন সাহেব হুযুর শুনিয়েছেন—মিশকাত জামাতে ভর্তি হওয়ার জন্যে তিনি যখন মালিবাগ মাদরাসায় এসেছেন, তখন ভর্তি পরীক্ষা দেন আল্লামা কাসেমী রহ.—এর কাছে। তাফসীরে জালালাইনের একটি প্রশ্নের উত্তর হুযুর হাশিয়া থেকে পড়ে শুনিয়ে দেন। এতে কাসেমী রহ. খুব খুশি হন। তিনি তখন পুরোনো ‘খত’—এ আরবী লিখতেন। দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় হুযুর আরবীতে উত্তর দিলেন এবং ক্লাসে প্রথম হলেন। এরপর কাসেমী রহ. তাকে পরামর্শ দিলেন—জাদীদ খত শেখার জন্যে। মিশকাত পড়াকালে তিনি তখন নতুন করে লেখার অনুশীলন করলেন।
তার পাঠদান ছিল খুবই আকর্ষণীয়। প্রথমে কিতাব ছাড়াই ছাত্রদের পুরো সবক বুঝিয়ে দিতেন। ভেঙে ভেঙে বোঝাতেন। পুরো সবকে কতটা আলোচনা, শিরোনাম বলে তা ব্যাখ্যা করতেন। সবশেষে কিতাব পড়িয়ে দিতেন। শিক্ষকদের উদ্দেশে নসীহত করতে গিয়ে আমি কয়েকবার শুনেছি, তিনি এ পদ্ধতি বলে দিচ্ছেন। পুরো নাহবেমির কিতাবের সারনির্যাস বলে দিচ্ছেন। সন্দেহ নেই, এভাবে পড়ালে ছাত্রদের বোঝাও সহজ হবে, যোগ্যতাও বাড়বে।
ছাত্রদেরকে যে শুধুই পড়িয়ে দিতেন, পড়তে উৎসাহিত করতেন, ভালো পড়ার পদ্ধতি বাতলে দিতেন—এতটুকুই নয়। ছাত্রদের মনমানস গড়ার পেছনেও তিনি ছিলেন সদাসতর্ক। তার জীবনের একটি বড় দিক ছিল ‘ইতেদাল’ বা ভারসাম্য। বাড়াবাড়ি—ছাড়াছাড়ি তিনি এড়িয়ে চলতেন। এ মেজাজ যেন ছাত্রদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়, তিনি সে চেষ্টা করতেন। এজন্যে ছাত্রদেরকে শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রহ. লিখিত আলই’তিদাল ফী মারাতিবির রিজাল অধিক পরিমাণে পড়তে বলতেন। থানভী—মাদানী জাতীয় কোনো বিভেদ যেন মস্তিষ্কে চেপে না বসে, এ বিষয়েও তিনি সতর্ক করতেন। বারবার বলতেন আকাবির—আসলাফের জীবনী, রচনা, আলোচনা পড়ার জন্যে।
রাজনীতিতে তিনি জড়িয়েছেন সেই ৭৫ সালে। কিন্তু দীর্ঘদিন তিনি ছাত্ররাজনীতির বিরোধী ছিলেন। অবশেষে সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিজের অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। তবে তার সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের ছাত্রশাখাটি যেন অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের মতো না হয়ে পড়ে, সে বিষয়েও ছিলেন সদাসতর্ক। ছাত্রজমিয়তের কর্মীদের জন্যে আলাদা একটি পাঠ্যসূচি তৈরির চিন্তা করেছিলেন তিনি। করোনা—মহামারির আগে তিনি এর দায়িত্ব দিয়েছিলেন আমাদের জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়ার শায়খুল হাদীস মাওলানা আবুল বাশার সাহেব হুযুরসহ অন্যদেরকে। সে কাজ সম্পাদনের পরিকল্পনাও করা হয়েছিল। আসাতিযায়ে কেরাম আমাকেও সঙ্গে রেখেছিলেন। কিন্তু করোনার আকস্মিক পরিস্থিতিতে সব এলোমেলো হয়ে যায়। কাজটি আর করা হয়নি। হুযুর এর মধ্যে চলেই গেলেন। ছাত্রজমিয়তের জন্যে আর কেউ কি সিলেবাসের কথা ভাববে? আমি এ কথা ভেবে তৃপ্তি পাই—আল্লামা কাসেমী রহ.—এর নির্দেশিত একটি কাজ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় আমিও ছিলাম। পরিকল্পনা করেছিলাম। কাজটি করার সুযোগ পাইনি। মুমিন তো নিয়তের জন্যেও পুরস্কৃত হয়।
আগেই বলেছি—ইসলাম, দ্বীন, জাতি, রাষ্ট্র, সমাজ, মোটকথা এমন কোনো দিক নেই যা নিয়ে হুযুর সোচ্চার হতেন না। সর্বদিকেই ছিল তার সচল ও সরব পদচারণা।
অবহেলিত জনপদে ইসলামের প্রচার—প্রসার এবং অমুসলিমদের থাবা প্রতিহত করার বিষয়ে ছিলেন সদা চিন্তিত। সেসব জনপদে মকতব প্রতিষ্ঠার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। তিনি চাইতেন, ঢাকা শহরের একেকটি মাদরাসা যেন প্রান্তিক একেকটি জেলার দায়িত্ব নেয়। সে জেলায় তারা পরিকল্পিতভাবে দাওয়াতি কার্যক্রম চালাবে। দাওয়াতুল ইসলামের যে জামাতগুলো বিভিন্ন এলাকায় রওনা হতো, সম্ভব হলে হুযুর তাদেরকে নির্দেশনামূলক ‘হেদায়াতি কথা’ বলে দিতেন। হিম্মত জোগাতেন, সাহস দিতেন। উৎসাহ—উদ্দীপনা প্রদান করতেন। একেবারে মৃতপ্রাণ না হলে এটা সম্ভব ছিল না যে, হুযুরের মজলিসের পর তার চেতনা তাকে নাড়া দেবে না, তার হিম্মত জেগে উঠবে না।
দিনে দিনে হুযুর সম্পর্কে কত কথা শুনেছি, জেনেছি। মুগ্ধতা ছড়ানো কত বিষয় তার জীবনের পাতায় পাতায় ছড়ানো! আমরা আশাবাদী, তাঁর যোগ্য শিষ্যগণ তাঁর জীবনের সেসব দিক আমাদের আলোকপাত করবেন। আমরা এতে খুঁজে পাব আমাদের এগিয়ে চলার পাথেয়।
যে ভালোবাসা তিনি অর্জন করেছিলেন এ যুগে তা সত্যিই বিরল। একজন যোগ্য সচেতন বর্ষীয়ান আলেমে দ্বীন হিসেবে নিজে সক্রিয় থেকে যা কিছু করা দরকার ছিল, তিনি সবই করেছেন। তার প্রতি এ ভালোবাসার একটি ছোট প্রকাশ ঘটেছে তার নামাযে জানাযায়। জাতীয় ঈদগাহে জানাযার অনুমতি না মেলায় বায়তুল মুকাররমে অনুষ্ঠিত হয় জানাযার নামায। জানাযায় এত অধিক পরিমাণ মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল যে তা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
তিনি চলে গেছেন। মানুষ তো চলেই যায়। পৃথিবী চলতে থাকে তার আপন গতিতে। কারও জন্যেই পৃথিবী দাঁড়ায় না মুহূর্তকালের জন্যে। তবে কারও কারও অনুপস্থিতি সৃষ্টি করে শূন্যতার। মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী রহ. ছিলেন এক মহীরুহ, যার ছায়ায় আশ্রয় খুঁজে পেত বহু মানুষ। যে গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করে তিনি চলে গেলেন, কে জানে, এ শূন্যতা কখনো পূরণ হবে কি না।
রাত ১১.৩১
২৩.১২.২০২০
দয়া করে লেখকের পরিচয়টা কেউ দিবেন কি? লেখাটি আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী রহ. স্মারকগ্রন্থের জন্য নির্বাচন করেছি। লেখকের পরিচয়টা দরকার। অগ্রীম জাজাকুুল্লাহ
লেখকের নামঃ মাওলানা শিব্বীর আহমদ
জাযাকুমুল্লাহ খাইরান। লেখাগুলো শেয়ার করলে সবাই উপকৃত হবে ইন-শা-আল্লাহ্