প্রতিষ্ঠাতা: মুজাহিদে আযম হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.

জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ, ঢাকা-এর মুখপত্র

প্রতিষ্ঠাকালঃ ১৯৩৭ ঈসায়ী

সংকটে দেশ : কিছু খণ্ড চিত্র

সংকটে দেশ : কিছু খণ্ড চিত্র

আবু সাফফানা


ক্ষুধা, দারিদ্র্য, সংকট—সম্ভবত এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর বিশ্ব আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। জীবন নিয়ে মানুষ যেমন শঙ্কায় পড়ে তেমনই জীবিকা নিয়েও পড়ে যায় মহামুসিবতে। করোনাকালীন বিধি—নিষেধে পড়ে মানুষের জীবনযাত্রা যেন স্থবির হয়ে পড়ে। বহু পরিবার শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে গেছে। টানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বহু স্কুল শিক্ষককে খেতে কাজ করতে হয়েছে। কেউ কেউ ভ্যানে করে শাক—সবজি বিক্রি করেছেন। এরপর বিধি—নিষেধ শিথিল হওয়া শুরু করলে মানুষ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। ধীরে ধীরে কর্মসংস্থান খুঁজে নেয়। মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষ আবার সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে টিকে থাকার সংগ্রামে রত হয়।

কিন্তু সমস্যা যেন তাদের পিছু ছাড়ে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তাদের উপার্জনের সমন্বয় হয় না কোনোভাবেই। মানুষ ভাবে, কিছুদিন পর সবই ঠিক হয়ে যাবে। আশায় বুক বেঁধে এগিয়ে যায়। কিন্তু পরিস্থিতি তাদের সঙ্গ দেয় না। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকে নানা অজুহাতে। রাশিয়া—ইউক্রেন যুদ্ধের দামামা বেজে উঠতেই ভোজ্য তেলের দাম আকাশে ওঠে। তেলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বৃদ্ধি পেল নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যই। রমযানে রোযা রেখে তৃপ্তিভরে ইফতার করারও ভাগ্য হলো না গরিব মানুষের।

এর মধ্যে জুলাই (২০২২) এর শুরুতে দেশব্যাপী বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংকট চরম আকার ধারণ করে। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়, রাশিয়া—ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের মূল্য বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখতে হচ্ছে। যে কারণে চাহিদা মোতাবেক বিদ্যুৎ উৎপাদন না হওয়ায় লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। প্রচণ্ড গরমের মাঝে বিদ্যুৎবিভ্রাটে দেশবাসী যখন নাকাল তখনই ঘটল ‘বিনা মেঘে বজ্রপাত’। ৫ আগস্ট ২০২২ শুক্রবার রাত ১২টার পর থেকে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে গড়ে ৪৭ শতাংশেরও বেশি। জ্বালানি তেল এমন এক পণ্য, যার ব্যবহার কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, পরিবহন, শিক্ষা ও চিকিৎসা সর্বব্যাপী। অতএব এর কারণে সবকিছুর দাম আবারও বৃদ্ধি পেয়েছে। জনগণ এমনিতেই খাদ্যসামগ্রী এবং ওষুধের দাম বৃদ্ধিতে সীমাহীন সংকটের মুখে। এর মধ্যে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে ভোক্তাদের সামান্য সচ্ছলতাও যদি অবশিষ্ট থেকে থাকে, সেটাও ছিনতাই হয়ে গেছে।

সংকট ও সমস্যা নিয়েই মানুষের জীবন। এসবের মধ্য দিয়েই জীবন পাড়ি দিতে হয়। সংকট ও সমস্যা ব্যতীত নির্বিঘ্ন জীবন কাটিয়ে দেব বললেই তা সম্ভব নয়। তাই ইসলাম আমাদের সংকটে, সমস্যায় ধৈর্যধারণ করতে শিখিয়েছে। কারণ দুনিয়ার স্বাভাবিক নিয়মই এটা, সুখের পর দুখ আর দুখের পর সুখ। কিন্তু সংকট ও সমস্যা যেখানে প্রাকৃতিক কিংবা যৌক্তিক কোনো কারণ বহন করে না, অনিয়ম, দুনীর্তি, লুটপাট ও জুলুমের কারণে যখন একটি জাতি সংকটে পড়ে, তখন বিষয়টি আর স্বাভাবিক থাকে না। নাহয় জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ করে ডিমের দাম ডজনে ৩০/৩৫ টাকা বৃদ্ধি পায় কীভাবে? স্বাভাবিকভাবেই এখানে প্রশ্ন ওঠে, একটা ডিম উৎপাদনে ডিজেলের অবদান কত শতাংশ আর দাম বেড়েছে কত শতাংশ?

সয়াবিন তেলের মতো ডিমেও মুনাফা করার উদ্দেশ্যে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী।

সর্বত্রই চলছে অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা। কেমন যেন কাকে মেরে কে বড়লোক হবে সে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। নাহয় করোনা মহামারির করুণ সময়ে অসহায় মানুষের ত্রাণ চুরি করতে কেউ পারে? সে সময়ের দৈনিক পত্রিকার কয়েকটি শিরোনাম দেখলে ভুলে যাওয়া স্মৃতি আবার মনে পড়ে। ‘ত্রাণের চালে রাক্ষুসে থাবা’ (যুগান্তর), ‘ত্রাণ চুরি বন্ধে পুলিশকে কঠোর নির্দেশনা’ (কালের কণ্ঠ), ‘হতদরিদ্রদের চাল চুরি—কাঙালের ধনেও থাবা’ (সমকাল), ‘চাল চুরির হিড়িক’ (ইনকিলাব), ‘চালের গাড়ি যাচ্ছিল স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার গোডাউন থেকে আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে’ (মানবজমিন), ‘করোনাতেও ২২২৪ বস্তা সরকারি ত্রাণের চাল চুরি’ (কালের কণ্ঠ), ‘লালমোহনে ইউপি সদস্যের ঘরের মাটি খুঁড়ে চাল উদ্ধার করল পুলিশ’ (মানবজমিন), ‘ত্রাণের টাকা আত্মসাৎ, হটলাইন অকার্যকর’ (সমকাল), ‘শিবচরে একশ’ বস্তা চালসহ সহযোগী আটক, পালাল আওয়ামী লীগ নেতা’ (মানবজমিন), ‘বিভিন্ন স্থানে ৭ জনকে সাজা, আটক ১০ : আরও ৮০০ বস্তা চাল জব্দ’ (যুগান্তর)।

স্বাধীনতার পর থেকে দুর্নীতির সূচনা হয় রিলিফ দুর্নীতি দিয়ে। এ কারণে বঙ্গবন্ধুকে দুঃখ করে বলতে হয়েছিল : ‘সবাই পায় সোনার খনি, আর আমি পেয়েছি চোরের খনি।’ উল্লেখ্য, স্বাধীনতা—উত্তরকালে বাংলাদেশে অনুদান হিসেবে আগত রিলিফসামগ্রীর একটি বড় অংশ নেতাকমীর্ ও দায়িত্বশীলরা যোগসাজশ করে আত্মসাৎ করেন।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশে প্রচুর অনুদান আসে। খাদ্যসামগ্রী, গুড়াদুধ, ঢেউটিনসহ নানা রকম রিলিফসামগ্রীর মধ্যে কম্বল এসেছিল সবচেয়ে বেশি। ওই কম্বল যাদের দেওয়ার কথা, তাদের না দিয়ে রিলিফ চেয়ারম্যানরা রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে যোগসাজশ করে আত্মসাৎ করে খোলাবাজারে বিক্রি করেছিলেন। এসব জেনে বঙ্গবন্ধু কষ্ট পেয়ে বলেছিলেন : ‘আমার কম্বলটা কই?’

এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই সময় আমেরিকার দেওয়া খাদ্য সাহায্যের মাত্র ১০ শতাংশ পৌঁছেছিল উপযুক্ত ব্যক্তিদের হাতে। বাকি ৯০ শতাংশ কী হয়েছিল, সে সম্পর্কে তারা কিছু না বললেও আকলমান্দদের জন্য বিষয়টি বোধগম্য। (তথ্যসূত্র : যুগান্তর : এপ্রিল ২০২২)

স্বাধীনতার পর শুরু হওয়া অনিয়মের ক্রমবর্ধমান ধারাই আজ দেশকে কঠিন পরিস্থিতির মুখে ফেলে দিয়েছে। ক্ষমতার পালাবদলে যারা সরকারে এসেছে তাদের কারও সময়েই এ অনিয়ম বন্ধ করা যায়নি। বরং দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে অনিয়ম এখন বহু জায়গায় নিয়মে পরিণত হয়েছে। ঘুষ—উৎকোচ খুবই সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সরকারি কাজ হবে আর সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা সুবিধা পাবেন না, তা হবার নয়। চোখে দেখা, নিজে শিকার হওয়া, নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি থেকে শোনা কিংবা পত্রিকার পাতা ইত্যাদি মাধ্যমে আমরা এসবের সঙ্গে সকলেই পরিচিত। তবুও আজ দৈনিক পত্রিকার পাতা থেকে কিছু চিত্র আবার দেখে আসতে পারি।

 

সরকারি অর্থ ব্যয়ে অনিয়ম

‘সরকারি মাল দরিয়া মে ডাল’ বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। চলমান পরিস্থিতি দেখলে প্রবাদটির যথার্থতা বেশ ভালোভাবেই বুঝে আসে। ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ যুগান্তরের এক প্রতিবেদনে এসেছে, ‘সরকারি অর্থ ব্যয়ের মধ্যে সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত হয়েছে। সিএজির সর্বশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে (২০১৬—১৭) উঠে এসেছে এমন তথ্য। এর মধ্যে বহুল আলোচিত ব্যাংকিং খাতে রয়েছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। বাকি ১৩ হাজার ১৫শ কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থায়।’

কেবল এক বছরেই অনিয়ম হয়েছে এ পরিমাণ অর্থ। অনিয়মগুলো কীভাবে হয় তার খানিক অনুমান করা যেতে পারে কিছু সংবাদ থেকে।

নয়াদিগন্ত, ২০ মে ২০১৯ : আমাদের বালিশ দুনীর্তির কথা মনে থাকার কথা। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা বলছি। এই প্রকল্পে একটি বালিশ ক্রয়ের খরচ দেখানো হয়েছে পাঁচ হাজার ৯৫৭ টাকা। আর এই বালিশ ভবনের ওপরে উঠাতে বিল করা হয়েছে ৭৬০ টাকা প্রতিটি।

বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৩১ আগস্ট ২০১৯ : সার্জারির শিক্ষার্থীদের ‘প্রিন্সিপাল অ্যান্ড প্র্যাকটিস অব সার্জারি’ বইটি গোপালগঞ্জের শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজের জন্য ১০টি কপি কিনেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বইটির বাজারমূল্য সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা হলেও স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রতিটি বই কিনেছে ৮৫ হাজার ৫০০ টাকায়।

প্রথম আলো, ৭ ডিসেম্বর ২০১৯ : ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে ব্যবহৃত একটি পর্দা ক্রয়ের দাম ধরা হয়েছে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

মানবজমিন, ২৯ জুলাই ২০২২ : বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের একটি ভবন মেরামতের ব্যয় দেখানো হয়েছে ৮ কোটি টাকা। অথচ এ ভবন নির্মাণে ব্যয় হয় ৪ কোটি টাকা।

প্রথম আলো, ২২ আগস্ট ২০২২ : ঢাকার দুই সিটি ও চট্টগ্রাম সিটিতে পরীক্ষা করে বর্জ্য অপসারণে অকার্যকর প্রমাণিত হওয়ার পরও ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে আটটি উইড হারভেস্টার যন্ত্র কেনা হয়েছে। এর আগে রাস্তাঘাটের ধুলা পরিষ্কার করতে ২০টি রোড সুইপার ট্রাক কেনা হয়েছিল। ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা এসব সুইপারে ধুলা পরিষ্কারের বদলে বরং বেশি করে ধুলা ওড়ে।

 

সড়ক—মহসড়কে

বিগত কয়েক বছরে রাস্তাঘাটের যে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। জীবনযাত্রা অনেক সহজ হয়েছে। কিন্তু এ উন্নয়ন যে অনেকের ব্যক্তি উন্নয়নের মহাসড়ক তৈরি করেছে তা—ও এখন আর গোপন কথা নয়। সংবাদপত্রের কিছু চিত্র দেখা যেতে পারে :

কালের কণ্ঠ, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০ : সিলেট শহর থেকে সড়কপথে সীমান্তবর্তী এলাকা তামাবিল স্থল শুল্কবন্দরের দূরত্ব ৫৬ কিলোমিটার। বিদ্যমান দুই লেনের ৫৬ কিলামিটার সড়ককে চার লেনে উন্নীত করার জন্য একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ৫৬ কিলোমিটারের দুই লেনের সড়ককে ৪ লেনে উন্নীত করার যে খরচ ধরা হয়েছে তাতে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে ৬৪ কোটি টাকা।

প্রথম আলো, ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ : ঢাকা—সিলেট বিদ্যমান দুই লেন সড়ককে চার লেনে উন্নীত করতে যে টাকা খরচ ধরেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। ২০৯ কিলোমিটার দৈর্ঘে্যর সড়কটি নির্মাণে খরচ হবে ১৭ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। সে হিসাবে কিলোমিটারপ্রতি খরচ হবে ৮২ কোটি টাকা।

এ তো গেল সড়ক নির্মাণে অনিয়মের কথা। অনিয়মের পরও সড়ক তো হলো! কিন্তু বিনা প্রয়োজনে যখন সেতু নির্মাণ করা হয় তখন তাকে আমরা কী বলতে পারি। সেতু নির্মাণে এমনই অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে প্রথম আলোর এক জরিপে। তা—ও সে ২০১৬ সালের জরিপ। এখন তো আমরা আরও উন্নতি করেছি। তথ্যটি পত্রিকার ভাষায় পড়–ন :

‘সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় সারা দেশে অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে পৌনে তিন হাজার সেতু। হাজার কোটি ব্যয়ে নির্মিত এসব সেতু মানুষের কোনো কাজে লাগছে না। কারণ, এসব সেতুর কোনো সংযোগ সড়ক নেই। কোথাও কোথাও ফসলি জমির মাঝে নির্মাণ করা হয়েছে সেতু। এমনও আছে, আশপাশে রাস্তা নেই, কিন্তু পাশাপাশি দুটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এসব সেতু নির্মাণের প্রকল্প কীভাবে গ্রহণ করা হলো?

এলজিইডির পাশাপাশি এ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের আরেকটি বড় প্রতিষ্ঠান সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। সওজের তত্ত্বাবধানে হওয়া সারা দেশে প্রায় ৮০টি সেতুর নির্মাণকাজ চলছে বছরের পর বছর। কবে কাজ শেষ হবে, কেউ জানে না। এ সেতুগুলো নির্মিত হচ্ছে আরেক অবাস্তব প্রক্রিয়ায়। প্রথম ধাপে পিলার নির্মাণ করা হয়। তারপর ওপরের অংশের জন্য দরপত্র ডাকা হয়। এখানেও সংযোগ সড়কের খবর নেই। সংযোগ সড়ক আলাদা প্রকল্প হিসেবে রাখা হয়েছে। আবার এগুলোর অধিকাংশের কার্যাদেশ দেওয়ার পর সেতুর দৈর্ঘ্য বাড়ানো হয়। বাড়তি টাকা বরাদ্দ করা হয়। কোনো কোনো সেতুর ক্ষেত্রে এটা একাধিকবার ঘটেছে। প্রশ্ন হলো, পিলার, পাটাতন, সংযোগ সড়ক ভাগ ভাগ করে করার কারণ কী? একসঙ্গে সমন্বিতভাবে হবে না কেন? এতে টাকা সাশ্রয়ের কোনো সুযোগ কি আছে? বাস্তবে তো আমরা দেখছি, এটা টাকা লুটপাটের একটা কারখানা।—প্রথম আলো, ৩ নভেম্বর ২০১৬

 

ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম

‘৪ হাজার কোটি টাকা তেমন কিছু নয়’ সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহীতের এ মন্তব্য সবারই মনে               থাকার কথা। হলমার্ক গ্রুপ জালিয়াতির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংক থেকে এ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর অর্থমন্ত্রী এ মন্তব্য করেছিলেন। পরে মন্ত্রী এর ব্যাখ্যা দিয়ে ক্ষমাও চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বছরে চার লক্ষ চল্লিশ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। সেখানে চার হাজার কোটি টাকা কোনো সংকট সৃষ্টির জন্য উপযুক্ত নয়।’ মন্ত্রীর এ কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কি না জানি না, জালিয়াতি করে অর্থ লোপাটের সে ধারা আজও বন্ধ হয়নি।

গত ১০ বছরে ব্যাংক খাতের ১০টি বড় কেলেঙ্কারিতে লোপাট হয়েছে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। এসব কেলেঙ্কারি ঘটেছে মূলত সরকারি ব্যাংকে। সোনালী ব্যাংকের হল—মার্ক গ্রুপ দিয়ে শুরু হলেও সবচেয়ে বেশি কেলেঙ্কারি ঘটেছে জনতা ব্যাংকে। আরও রয়েছে বেসিক ও ফারমার্স ব্যাংকের অনিয়ম—দুর্নীতির ঘটনা।

২০১৮ সালে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ‘বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে আমরা কী করব’ শীর্ষক সংলাপের আয়োজন করে। সে সংলাপে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। ব্যাংক খাতের এই ১০টি বড় কেলেঙ্কারিতে লোপাট হওয়া টাকা দিয়ে কী করা সম্ভব, তারও একটি চিত্র তুলে ধরেছে সিপিডি। সেখানে বলা হয়েছে, এই টাকা দিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের ৭৮ শতাংশ বা পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্পের ৬৪ শতাংশ ব্যয় নির্বাহ করা যেত। আবার সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে প্রায় ৪১ শতাংশ টাকার জোগান দেওয়া সম্ভব ছিল।—প্রথম আলো, ৯ ডিসেম্বর ২০১৮

 

বিদেশে অর্থপাচার

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৭৪ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। এর মধ্যে শুধু ২০১৫ সালেই পাচার হয়েছে এক লাখ কোটি টাকার বেশি। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। জিএফআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত (২০১৪ সাল বাদে) ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে চার হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় চার লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ৯০ টাকা হিসাবে)। এই পরিমাণ অর্থ দেশের চলতি বছরের (২০২১—২০২২) জাতীয় বাজেটের প্রায় সমান। অর্থপাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০টি দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম।—কালের কণ্ঠ, ১৮ ডিসেম্বর ২০২১

 

বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট : কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়

রাশিয়া ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ইউক্রেনে হামলা করলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম ১৩৯ ডলার পর্যন্ত উঠেছিল ব্যারেল প্রতি। দেশে যখন মূল্যবৃদ্ধি করা হয় তখন ৯০ ডলারে নেমে এসেছে। বিভিন্ন জ্বালানি তেল—বিষয়ক সংস্থার পূর্বাভাস হচ্ছে এ বছরের শেষ নাগাদ ব্যারেলপ্রতি ৮০ ডলারে নেমে আসবে। বিশ্ববাজারে যখন ধীরে ধীরে স্বস্তি ফিরে আসছে, তখনই আমাদের বাজারে দাম বাড়িয়ে চরম অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিলো সরকার।

মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে সরকার ঘুরিয়ে—ফিরিয়ে তিনটি কারণ উল্লেখ করেছে।  প্রথমত, বিশ্ববাজারে সংকট ও মূল্যবৃদ্ধিকে মূল কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) লোকসান কামানো ও ভারতে পাচাররোধকেও মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে।

সরকারের মূল্যবৃদ্ধির কোনো যুক্তিই গ্রহণযোগ্য নয়। বিশ্ববাজারে সর্বোচ্চ দাম থাকার সময় সরকার ভতুর্কি দিয়েছে। এখন দাম কমার সময় অযৌক্তিকভাবে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ হারে দাম বাড়িয়েছে। কারণ হিসেবে বিপিসির লোকসানের কথা বলা হচ্ছে। জুলাই মাসে বিপিসি ডিজেল ও অকটেনে ৭৮ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। ফেব্রুয়ারি থেকে লোকসানের পরিমাণ ৮ হাজার ১৪ কোটি টাকা। অথচ ২০১৩—১৪ অর্থবছর থেকে বিপিসি জ্বালানি তেল বিক্রি করে লাভ করেছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা।

ফলে দেখা যাচ্ছে, বিপিসির লোকসানের যে কথা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তা সর্বাংশে সঠিক না। তর্কের খাতিরে সরকারের যুক্তি মেনে নিয়েই বলতে হবে, বিপিসি এখনো লাভেই আছে। ফেব্রুয়ারি থেকে লোকসানের অর্থ বাদ দিলেও বিপিসির হাতে এখনো ৩৫ হাজার কোটি টাকা থাকার কথা। এই অর্থ থেকে সরকার জ্বালানিতে ভতুর্কি দিতে পারত। না দিয়ে সরকার অন্য খাতে এই অর্থ ব্যয় করছে। আর্থিক খাতে একধরনের লুটপাট ও অর্থ পাচারের কারণে সম্ভবত সরকারের হাতে পর্যাপ্ত টাকা নেই। বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলের পরিমাণ নিয়ে নানা ধরনের আলাপ—আলোচনা শোনা যাচ্ছে। ফলে সরকার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ বিভিন্নভাবে জনসাধারণের পকেট কাটার চেষ্টা করছে। বৈশ্বিক সংকট বা বিপিসির লোকসানের কারণ উল্লেখ অজুহাত মাত্র।—প্রথম আলো, ৮ আগস্ট ২০২২

 

দুনীর্তির তালিকা কেবল সুদীর্ঘই নয়, এ যেন অন্তহীন সিঁড়ি। এ সিঁড়ি বেয়ে কে কতটা নিচে নামতে পারে সে প্রতিযোগিতাই চলছে। ওপরের আলোচনায় একটি খণ্ডচিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র। যাতে সুজলা—সুফলা—শস্য—শ্যামলা বাংলাদেশের এ বেহাল পরিণতির কারণ অনুসন্ধান করা সহজ হয়। এর ওপর আছে বিভিন্ন অজুহাতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে ঋণ নেওয়ার এক অনিঃশেষ ধারা। এটি প্রচলিত অর্থনীতির ব্যর্থ দিক। বাংলাদেশের মতো পিছিয়ে পড়া দেশের যে পরিমাণ ঋণ আছে তা হিসাব করলেও মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো। সে ঋণও আবার সুদভিত্তিক, কোনোটা কঠিন শর্তের উঁচু দরের সুদভিত্তিক। এমন অর্থনীতির দেশে বসবাস করা মানেই আপনার ইচ্ছা না থাকলেও সুদের সঙ্গে আপনাকে জড়িয়ে রাখবে ওতপ্রোতভাবে।

 

বাংলাদেশের ঋণ

২০২২—২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। বাজেটের সামগ্রিক ঘাটতি ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। যা পূরণ করার জন্য বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণ করা হবে। ২০২২—২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধে চতুর্থ সর্বোচ্চ বরাদ্দ রেখেছে সরকার।

বর্তমানে দেশের প্রতিটি নাগরিকের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ৯৫ হাজার ৬শ টাকা। আজ যে শিশুটি জন্ম নেবে, তার মাথায়ও সমপরিমাণ ঋণের দায় চাপবে। গত এক বছরে মাথাপিছু ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৮৩০ টাকা। আগামী এক বছরে এটা আরও প্রায় ১৫ হাজার টাকা বাড়বে। ফলে ওই সময়ে মাথাপিছু ঋণের স্থিতি দাঁড়াবে ১ লাখ ১১ হাজার টাকা। (তথ্যসূত্র : যুগান্তর : ১১  জুন ২২)

শুধু রাশিয়া, চীন ও ভারতের সঙ্গে এ পর্যন্ত সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণচুক্তি হয়েছে। আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে সুদ, আসলসহ এ বিপুল অঙ্কের ঋণ পরিশোধ করতে হবে।  অন্যান্য দেশ ও দাতা সংস্থার ঋণের তুলনায় এ তিন দেশের ঋণের শর্ত কঠিন। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, বিদায়ী অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের আসল, সুদসহ ২০১ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। ২০২৪—২৫ অর্থবছরে তা ৪০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছে ইআরডি। ২০২৯—৩০ অর্থবছরে ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ ৫১৫ কোটি ডলার খরচ হবে।

 

এ অনিয়ম, দুনীর্তি ও বিশৃঙ্খলা রোধ করা না গেলে দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা যে ধীরে ধীরে কোন পর্যায়ে গিয়ে পেঁৗছবে তা কল্পনা করাও মুশকিল। রাস্তা—ঘাট, উঁচু ইমারত, উড়াল সড়ক মেট্রোরেল, দামি ব্র্যান্ডের গাড়ির বহর দিয়ে যারা দেশের উন্নয়নের কথা বলতে চান, তারা আসলে দেশের একাংশের কথা বলেন। যারা সকল সুযোগ—সুবিধা ভোগ করে আঙুল ফুলে কলা গাছ হচ্ছে। এর বিপরীতে দেশে যে ৪০ ভাগেরও বেশি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছে তার খবর তারা জানেন না কিংবা জেনেও না জানার ভান করেন। দেশে দিন দিন বৈষম্য বেড়েই চলছে। একদিকে অতিধনী বৃদ্ধির হারের দিকে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। ধনী বৃদ্ধির হারে তৃতীয়। অপর দিকে অতিগরিব বা হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। বাংলাদেশে ২ কোটি ৪১ লাখ হতদরিদ্র মানুষ আছে। অনিয়ম, দুনীর্তি ও বিশৃঙ্খলার ব্যাপারে সকলেই সতর্ক হই। প্রত্যেক নিজ নিজ জায়গা থেকে প্রতিবাদ করি। নিজের আওতার মধ্যে অনিয়ম বন্ধে সচেষ্ট হই। না হয় এর খেসারত দিতে হবে সাধারণ মানুষকে।

বাংলাদেশকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে মূল ও প্রধান ভূমিকা রাখতে হবে নেতৃস্থানীয়দের। কারণ, দেশের এ পরিস্থিতির সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে কর্তাব্যক্তিরাই জড়িত। আরবীতে একটি কথা আছে :

اَلنَّاسُ عَلَى دِيْنِ مُلُوْكِهِمْ.

অর্থাৎ মানুষ তাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাদেরকে নিজেদের আইডল ও আদর্শ মনে করে। অবচেতন মনে তাদের স্বভাব—চরিত্র নিজেরা ধারণ করে। ফলে নেতারা যখন অন্যায়, অপরাধ, অনিয়ম ও দুনীর্তিতে জড়িয়ে পড়ে এবং একসময় তা নিয়মে পরিণত হয়ে যায়, তখন সাধারণ মানুষের মন থেকে তার অপরাধবোধও শেষ হয়ে যায়। সে সময় কিছু ব্যতিক্রমী খোদাভীরু মানুষ ব্যতীত সবাই নিজ নিজ গণ্ডিতে ক্ষমতা দখল, ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও দুনীর্তি চালিয়ে যায়। দেশের বর্তমান অবস্থায় এ প্রবাদটি যে শতভাগ সত্য তা বোঝার জন্য খুব বেশি জ্ঞান বা দিব্যদৃষ্টির প্রয়োজন পড়ে না।

লেখক সম্পর্কে
Avatar

zobayer

একটি কমেন্ট করুন