প্রতিষ্ঠাতা: মুজাহিদে আযম হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.

জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ, ঢাকা-এর মুখপত্র

প্রতিষ্ঠাকালঃ ১৯৩৭ ঈসায়ী

সুখের নীড়

সুখের নীড়

মোল্লা সাবেত খান

 

শোকর ও সবরের সমন্বিত জীবন

পৃথিবী ক্ষণস্থায়ী। এ পৃথিবীতে আমাদের জীবন আরও ক্ষণস্থায়ী। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভাষায়, মুসাফিরের যাত্রাপথে গাছের ছায়ায় একটু বিশ্রামমাত্র। একটি মানুষ জন্মগ্রহণের পর থেকে অনিবার্য মৃত্যুর দিকেই ধাবিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কখন বিদায়ঘণ্টা বেজে উঠবে কেউ বলতে পারে না। ক্ষণস্থায়ী এ ক্ষুদ্র জীবনে কত পরিস্থিতিরই না মুখোমুখি হতে হয় আমাদের। একজন মানুষের সমগ্র জীবনের সকল পরিস্থিতিকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। সুখ ও দুঃখ। সুখ ও দুঃখের সমন্বয়েই গঠিত আমাদের এ ক্ষুদ্র জীবন। জীবনে কেবলই সুখ কিংবা কেবলই দুঃখ, এমন হতে পারে না। কেবল সুখ আর সুখ, দুঃখ—কষ্টের লেশমাত্র নেই—তা হবে জান্নাতে। আর কেবল দুঃখ আর কষ্ট, সুখ বলতে কিছুই নেই—তা হবে জাহান্নামে। এ পৃথিবী সুখ ও দুঃখের সমন্বয়ে গঠিত। হ্যঁা, কারও সুখ বেশি তো কারও দুঃখ বেশি।

মানুষ যখন সুখে থাকে তখন সবকিছু ভুলে গিয়ে ভোগ আর উপভোগে সময় পার করতে থাকে। বলা হয়, সুখের সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে যায়। এরপর যখন দুঃখের পালা আসে তখন এমন পরিতাপের অনলে পুড়তে থাকে যেন সে জীবনে কখনো সুখই পায়নি।

আমাদের জীবন যদিও সুখ ও দুঃখের সমন্বয়ে গঠিত তবুও জীবনে সুখের অবস্থাই বিরাজ করে বেশি। জীবনে যতগুলো বছর অতিক্রান্ত হয়েছে তার মধ্যে আমি কতদিন অসুস্থ ছিলাম আর কতদিন সুস্থ ছিলাম। কতদিন কেঁদেছি আর কতদিন হাসির বানে ভেসেছি। আমার জীবনে ক—বেলা পেটপুরে খেয়েছি আর ক—বেলা ক্ষুধার্ত থেকেছি। দেখা যাবে, বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে ভালো অবস্থায়। কিন্তু আমরা সুখের সময় মনে রাখি না। একবার জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়লে এমন অস্থির হয়ে পড়ি, অভিযোগ শুরু করি যে, জীবনে যেন কখনো সুস্থই থাকিনি।

এজন্য আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন বান্দার ব্যাপারে অনুযোগ করে বলেন,

وَ قَلِیْلٌ مِّنْ عِبَادِیَ الشَّكُوْرُ

আমার বান্দাদের মধ্যে শোকরগুজার বান্দা খুবই কম।—সূরা সাবা ৩৪ : ১৩

একজন ঈমানদারের বৈশিষ্ট্য হলো সুখের সময় আল্লাহর শোকর আদায় করবে আর দুঃখ—কষ্টের সময় সবর করবে। শোকর আর সবরের সমন্বিত জীবনই মুমিনের কাক্সিক্ষত জীবন। হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

الإِيْمَانُ نِصْفَانِ نِصْفٌ فِيْ الصَّبْرِ وَنِصْفٌ فِيْ الشُّكْرِ.

ঈমান দুইভাগে বিভক্ত। একভাগ সবরের মধ্যে, অপরভাগ শোকরের মধ্যে।—বাইহাকী, শুআবুল ঈমান : ৯৭১৫

চিন্তা করলে দেখব, দিন—রাতের পুরোটা সময় আল্লাহ পাকের নেয়ামত আমাকে জড়িয়ে রেখেছে। রাতের ঘুম আল্লাহর নেয়ামত, ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া আল্লাহর নেয়ামত।

وَّ جَعَلْنَا الَّیْلَ لِبَاسًا ﴿ۙ۱۰﴾  وَّ جَعَلْنَا النَّهَارَ مَعَاشًا ﴿۪۱۱﴾

রাত্রিকে করেছি আবরণ আর দিনকে করেছি জীবিকা অর্জনের সময়।—সূরা নাবা ৭৮ : ১০, ১১

দিনের আলো ও রাতের আঁধার এবং দিন—রাতের আবর্তন আল্লাহর নেয়ামত। আল্লাহ তাআলা বলেন,

قُلْ اَرَءَیْتُمْ  اِنْ جَعَلَ اللهُ عَلَیْكُمُ الَّیْلَ سَرْمَدًا  اِلٰی یَوْمِ الْقِیٰمَۃِ مَنْ اِلٰهٌ غَیْرُ اللهِ یَاْتِیْكُمْ بِضِیَآءٍ  اَفَلَا تَسْمَعُوْنَ ﴿۷۱﴾  قُلْ  اَرَءَیْتُمْ  اِنْ جَعَلَ            اللهُ عَلَیْكُمُ النَّهَارَ سَرْمَدًا  اِلٰی یَوْمِ الْقِیٰمَۃِ مَنْ اِلٰهٌ غَیْرُ اللهِ یَاْتِیْكُمْ بِلَیْلٍ تَسْكُنُوْنَ فِیْهِ ؕ اَفَلَا تُبْصِرُوْنَ ﴿۷۲﴾

বলুন, ভেবে দেখো তো, আল্লাহ যদি রাত্রিকে কেয়ামতের দিন পর্যন্ত স্থায়ী করেন, তবে আল্লাহ ছাড়া এমন উপাস্য কে আছে, যে তোমাদেরকে আলো দান করতে পারে? তোমরা কি তবুও কর্ণর্পাত করবে না?

বলুন, ভেবে দেখো তো, আল্লাহ যদি দিনকে কেয়ামতের দিন পর্যন্ত স্থায়ী করেন, তবে আল্লাহ ছাড়া এমন উপাস্য কে আছে যে, তোমাদেরকে রাত্রি দান করতে পারে, যাতে তোমরা বিশ্রাম করবে? তোমরা কি তবুও ভেবে দেখবে না?—সূরা কাসাস ২৮ : ৭১,৭২

আল্লাহ পাকই জমিন থেকে আমার জন্য খাবার উৎপন্ন করেন। তিনি বলেন,

اَفَرَءَیْتُمْ مَّا تَحْرُثُوْنَ ﴿ؕ۶۳﴾ ءَاَنْتُمْ تَزْرَعُوْنَهٗۤ  اَمْ نَحْنُ الزّٰرِعُوْنَ ﴿۶۴﴾ لَوْ نَشَآءُ  لَجَعَلْنٰهُ  حُطَامًا فَظَلْتُمْ تَفَکَّهُوْنَ ﴿۶۵﴾

তোমরা যে বীজ বপন করো, সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি? তোমরা তা উৎপন্ন করো, না আমি উৎপন্নকারী? আমি ইচ্ছা করলে তা খড়কুটা করে দিতে পারি, অতঃপর হয়ে যাবে তোমরা বিস্ময়াবিষ্ট।—সূরা ওয়াকিয়া ৫৬ : ৬৩—৬৫

মেঘ থেকে তো তিনিই সুপেয় পানি বর্ষণ করেন। তিনি বলেন,

اَفَرَءَیْتُمُ الْمَآءَ الَّذِیْ تَشْرَبُوْنَ ﴿ؕ۶۸﴾  ءَاَنْتُمْ  اَنْزَلْتُمُوْهُ مِنَ الْمُزْنِ اَمْ نَحْنُ الْمُنْزِلُوْنَ ﴿۹۶﴾  لَوْ نَشَآءُ  جَعَلْنٰهُ  اُجَاجًا فَلَوْلَا تَشْكُرُوْنَ ﴿۷۰﴾

তোমরা যে পানি পান করো, সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি? তোমরা তা মেঘ থেকে নামিয়ে আনো, না আমি বর্ষণ করি? আমি ইচ্ছা করলে তা লোনা করে দিতে পারি, অতঃপর তোমরা কেন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো না? —সূরা ওয়াকিয়া ৫৬ : ৬৮—৭০

এমনইভাবে আসমান, জমিন, চাঁদ, সূর্য, আলো, বাতাস, গাছপালা, নদী—নালা, দেহের প্রতিটি অঙ্গ—প্রত্যঙ্গ, মা, বাবা, ভাই, বোন, ছেলে, মেয়ে, আত্মীয়—স্বজন সবই আল্লাহ পাকের নেয়ামত। প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহ পাকের অসংখ্য নেয়ামত আমাকে জড়িয়ে রেখেছে। আল্লাহুম্মা লাকালহামদু ওয়া লাকাশশুকর।

যখনই আল্লাহ পাকের নেয়ামতের উপলব্ধি আসবে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ পাকের শোকর আদায় করা চাই। প্রচণ্ড গরম লাগছে, এমন সময় ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল। আল্লাহর শোকর আদায় করি। ব্যবসায় লাভ হলো, আল্লাহর শোকর আদায় করি। ঘরে গিয়ে স্ত্রী, সন্তানদের ভালো অবস্থায় দেখলে আল্লাহর শোকর আদায় করি। আজকের পড়া মুখস্থ করতে পেরেছি, আল্লাহর শোকর আদায় করি।

মনে করুন, কোনো অভাবী মানুষ আপনার দরজায় এলো। চেহারা ধূলো—মলিন। কাপড় ছেড়া। চুল উশকো—খুশকো। ক্ষুধার কারণে শরীর কাঁপছে। আপনি তার প্রতি দরদি হলেন। বাসায় এনে বসালেন। তার সামনে পোলাও, কোরমাসহ উপাদেয় হরেক রকম খাবার এনে দিলেন। লোকটি পেটপুরে খেল। যাওয়ার সময় নতুন জামা—কাপড় আর সঙ্গে এক লাখ টাকা দিয়ে দিলেন। একটু ভেবে দেখুন তো, লোকটার খুশির মাত্রা কেমন হবে? লোকটা কি খুশি ও আনন্দে নির্বাক হয়ে যাবে না? সে হতবিহ্বল হয়ে পড়বে না? সে কি আপনাকে ধরে কেঁদে উঠবে না?

কিন্তু লোকটি যদি একেবারে ঠিক যেভাবে আপনার দরজায় এসেছিল ঠিক সেভাবেই বেরিয়ে যায়। কৃতজ্ঞতাসূচক একটি শব্দ উচ্চারণ না করে। চেহারায় বিন্দুমাত্র আনন্দের আভা দেখা না দেয়, তাহলে কি লোকটিকে পাগল বলা হবে না? মানুষ তাকে কী বলবে? এর চেয়ে বড় নিমকহারাম আর হতে পারে?

লোকটি এমন ভাবলেশহীন আচরণ তখনই করতে পারে, যখন তার মধ্যে এসব দানের অনুভূতি না থাকে, সে যদি বদ্ধ পাগল হয় অথবা সে নিজেকে এর চেয়ে বেশির হকদার মনে করে কিংবা সে মনে করে যা কিছু আমাকে দেওয়া হলো এ সবই তো আমার নিজের।

আমি যে প্রতি মুহূর্ত আল্লাহ পাকের অমূল্য নেয়ামতে ডুবে আছি তার কী শোকর আদায় করছি? আল্লাহর অসংখ্য অগণিত নেয়ামত পেয়েও যদি শোকর আদায় না করি, মুখে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ উচ্চারিত না হয়, আচার—আচরণে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না পায়, তাহলে কি আমি সে লোকটির চেয়েও বেশি অকৃতজ্ঞ নই?

হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. বলেন, আল্লাহর শোকর আদায়ের মূল কথা হলো, যখনই নিজের মন—মেজাজের অনুকূল কোনো বিষয় ঘটবে, চাই তাতে আমার নিজের কোনো দখল থাকুক বা না থাকুক, তাকে অন্তর থেকে আল্লাহর নেয়ামত মনে করবে। এর কারণে আনন্দিত হবে। এ নেয়ামতকে নিজের তুলনায় অনেক বেশি মনে করবে। মুখে আল্লাহর শোকর আদায় করবে আর এ নেয়ামতকে কখনই আল্লাহর নাফরমানীতে ব্যয় করবে না।—ইসলাহী মাজালিস : ৭/৪৯

হাদীস শরীফে এসেছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার এক সাহাবীকে দেখলেন খুবই পুরোনো ও মলিন কাপড়ে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার কি অর্থ—সম্পদ নেই?

সাহাবী বললেন, আল্লাহ আমাকে সব ধরনের সম্পদই দান করেছেন।

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

إذا آتاك الله مالا فلير أثره عليك.

আল্লাহ যখন তোমাকে সম্পদ দিয়েছেন তখন তার ছাপও তোমার মাঝে দৃশ্যমান হওয়া চাই।

অপর এক হাদীসে বলেছেন,

إنَّ اللَّهَ يُحِبُّ إذَا أَنْعَمَ عَلَى عَبْدِهِ نِعْمَةً أَنْ يَرَى أَثَرَ نِعْمَتِهِ عَلَيْهِ.

আল্লাহ যখন তার বান্দাকে কোনো নেয়ামত দান করেন তখন সে নেয়ামতের ছাপ বান্দার মাঝে দৃশ্যমান হওয়া পছন্দ করেন।

বোঝা গেল, আল্লাহর নেয়ামত লাভ করে, প্রথমে এটা অন্তর থেকে আল্লাহর নেয়ামত হিসেবে গ্রহণ করা চাই। মনে এ বিশ্বাস অবশ্যই থাকবে যে আমার যোগ্যতা ও মর্যাদার বিচারে এ নেয়ামত অনেক অনেক বেশি। আমি কখনই এর যোগ্য ছিলাম না। এরপর মুখে আল্লাহর শোকর আদায় করবে। আচার—আচরণেও শোকর ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পাবে। এমনকি চলাফেরা ও কাপড়—চোপড়েও। এরপর আল্লাহর সে নেয়ামত যেন কোনো গোনাহে ব্যবহৃত না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

কেউ যদি জীবনের সকল প্রাপ্তিকে আল্লাহর পক্ষ থেকেই মনে করে। সে এটাও বিশ্বাস রাখে, আমি যার উপযুক্ত আল্লাহ তাআলা আমাকে তার চেয়ে বেশি দিয়েছেন, তার মনে কি কখনো না পাওয়ার বেদনা থাকতে পারে? শোকরের এ গুণই তো তাকে জীবনের কঠিন ধাপগুলোতে সবর করতে শক্তি জোগাবে। মানুষ যদি যা লাভ করে তাতেই তুষ্ট ও সন্তুষ্ট এবং তৃপ্ত ও পরিতৃপ্ত হতে পারে, তার চেয়ে সুখী আর কেউ হতে পারে না। মানুষের সকল অন্যায় ও অসুখের সূচনা হয় এ অকৃতজ্ঞতা থেকেই। এ কারণেই শয়তান যখন আল্লাহর দরবার থেকে বিতাড়িত হয়েছিল তখন সে বনী আদমকে সঠিক পথ থেকে বিভ্রান্ত করার শপথ করেই বেরিয়েছিল। সে আল্লাহর সামনেই বনী আদমকে কীভাবে গোমরাহ করবে সে পরিকল্পনাও তুলে ধরেছিল। তার চূড়ান্ত কথা ছিল :

وَلَا تَجِدُ اَكْثَرَهُمْ شٰکِرِیْنَ.

আপনি তাদের অধিকাংশকেই শোকরগুজার ও কৃতজ্ঞ হিসেবে পাবেন না।—সূরা আরাফ ০৭ : ১৭

অর্থাৎ শয়তান মানুষকে অকৃতজ্ঞ বানানোর প্রাণপন চেষ্টা করবে। কেউ অকৃতজ্ঞ হয়ে পড়লেই শয়তানের জালে ফেঁসে যাবে। বোঝা গেল, শোকরের এ গুণ ও বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেললেই মূলত মানুষের অধঃপতনের সূচনা হয়।

অতএব জীবনের সুখের সময়গুলোতে, ভালো সময়গুলোতে, সুস্থতার মুহূর্তগুলোতে আল্লাহর শোকর আদায় করা চাই। আর যখন কোনো বিষয় এমন আসবে যা আমার মন চায় না, তখন তা আল্লাহর ফয়সালা বলে মেনে নিয়ে সবর করবে। সবর একটি মহৎ গুণ। যেকোনো ইবাদত করতে সবরের প্রয়োজন হয়। যখন ইবাদত করতে মন চায় না তখন মনের বিরুদ্ধে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন হওয়াও সবর। যখন গোনাহের তাড়না আসে তখন সে তাড়না উপেক্ষা করতেও সবরের প্রয়োজন হয়। আবার যখন বিপদ—আপদ, বালা—মুসিবত এসে পড়ে তখন তাকে আল্লাহর ফয়সালা বলে মেনে নিয়ে সবর করতে হয়। সবরকারীর জন্যে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো আল্লাহ পাকের এ ঘোষণা,

اِنَّ اللهَ مَعَ الصّٰبِرِیْنَ

নিশ্চয়ই আল্লাহ আছেন ধৈর্যধারণকারীর সঙ্গে।

অপর আয়াতে আল্লাহ বলেন,

اِنَّمَا یُوَفَّی الصّٰبِرُوْنَ  اَجْرَهُمْ بِغَیْرِ حِسَابٍ

সবরকারীদেরকে তাদের বে—হিসাব প্রতিদান পরিপূর্ণরূপে দেওয়া হবে।—সূরা যুমার ৩৯ : ১০

সবর করতে পারলে, ধৈর্যধারণ করতে পারলে আমাদের জীবনের বহু বিবাদও মিটে যাবে। কারণ, আমাদের সমাজ ও পরিবারে বহু বিবাদের সূত্রপাত হয় রাগ থেকে। কারও কথা বা কাজে মানুষ রাগান্বিত হয়ে এমন কিছু বলে বা করে বসে যার ফলে বিবাদ শুরু হয়। এখানে একপক্ষ সবর করতে পারলেই আর বিবাদ বৃদ্ধি পায় না। হিংসা—বিদ্বেষের জন্মও এ শোকর ও সবর না থাকার কারণেই হয়। অন্যকে ক্ষমা করতে হলেও সবরের মহৎ গুণ প্রয়োজন। কোরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন,

الَّذِیْنَ یُنْفِقُوْنَ فِی السَّرَّآءِ وَالضَّرَّآءِ وَالْکٰظِمِیْنَ الْغَیْظَ وَالْعَافِیْنَ عَنِ النَّاسِ ؕ وَاللهُ یُحِبُّ الْمُحْسِنِیْنَ.

যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল উভয় অবস্থায় দান করে, ক্রোধ সংবরণ করে এবং মানুষকে ক্ষমা করে দেয়। আর যারা উত্তম কাজ করে তাদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন।—সূরা আলে ইমরান ০৩ : ১৩৪

এ আয়াতে কারও থেকে কষ্টকর কোনো বিষয়ের মুখোমুখি হলে তিনটি পর্যায়ে বিষয়টি সমাধান করার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। প্রথমে রাগ নিয়ন্ত্রণ করবে। রাগ হয়ে তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করবে না। এখানে রাগ করবে না বলা হয়নি; রাগ নিয়ন্ত্রণ করবে বলা হয়েছে। এর থেকে বোঝা যায়, এমন ক্ষেত্রে রাগ আসাটা স্বাভাবিক বিষয়। রাগ হওয়া মানুষের স্বভাবগত ও প্রকৃতিগত চরিত্র। অতএব রাগ আসবে। কিন্তু এ রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

দ্বিতীয় ধাপে ওই ব্যক্তির প্রতি মনে কোনো রাগ পুষে রাখা যাবে না। মন থেকে ক্ষমা করে দেবে।

তৃতীয় ধাপে তার সঙ্গে ভালো আচরণ করবে।

একবার হযরত আলী রাযি. ওযুর পানি চাইলেন। বাঁদি ওযুর পানি দিতে গিয়ে হযরত আলী রাযি.—এর গায়ে ফেলে দিল। স্বাভাবিকভাবেই এতে রাগ আসার কথা। বাঁদিও ছিল খুব সমঝদার। সঙ্গে সঙ্গে এ আয়াত তিলাওয়াত করল। যখন সে পড়ল,

وَالْکٰظِمِیْنَ الْغَیْظَ

(যারা রাগ নিয়ন্ত্রণ করে)

সঙ্গে সঙ্গে হযরত আলী রাযি.—এর রাগ পড়ে গেল।

এরপর যখন সে পড়ল,

وَالْعَافِیْنَ عَنِ النَّاسِ

(মানুষকে ক্ষমা করে দেয়)

সঙ্গে সঙ্গে আলী রাযি. বললেন, যাও তোমাকে মাফ করে দিলাম।

এরপর যখন তিলাওয়াত করল,

وَاللهُ یُحِبُّ الْمُحْسِنِیْنَ.

(আর যারা উত্তম কাজ করে তাদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন।)

আলী রাযি. বললেন, তোমাকে আমি আযাদ করে দিলাম।

—সূত্র : তাফসীরে মাআরিফুল কোরআন, মুফতী শফী রহ.

দেখুন, একজন বাঁদি অপরাধ করে বিনিময়ে মুক্তি ও আযাদীর দানে ধন্য হলো। আমরা হলে কী করতাম। আল্লাহ মাফ করুন।

শোকর ও সবরই হলো জীবনে সুখের চাবিকাঠি। এটা তো সবাই বিশ্বাস করে যে, আমার মনের সকল চাহিদা পৃথিবীতে পূরণ হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অতএব যা পাব তাতেই শোকর আদায় করব আর না পেলে সবর করব—এ মূলনীতিতে জীবন গঠন করতে পারলে জীবনে কষ্ট বলতে কিছুই থাকবে না। আপনাকে কেউ কখনো কোনো কষ্টেও ফেলতে পারবে না। বাহ্যিক বহু কষ্ট ও অভাবের মাঝেও আপনি থাকবেন সুখী ও পরিতৃপ্ত।

হযরত বাহলুল রহ.—কে কেউ প্রশ্ন করল, কেমন আছেন?

তিনি উত্তর দেন, ওই ব্যক্তির অবস্থা আর কী জানতে চাও যার মর্জিমতো ইহজগতের সবকিছু ঘটে।

প্রশ্নকারী তাজ্জব হয়ে জানতে চাইল, এটা কীভাবে সম্ভব?

উত্তরে তিনি বললেন, এটুকু তো তুমি জানো বিশ্বজগতের সবকিছু আল্লাহ পাকের ইচ্ছামাফিক হয়ে থাকে। আমি আমার ইচ্ছা আল্লাহ পাকের ইচ্ছার মধ্যে বিলীন করে দিয়েছি। তাঁর ইচ্ছার অনুগামী করে দিয়েছি। এখন যা কিছুই ঘটে তা আমার ইচ্ছানুপাতেই ঘটে থাকে।—তাসহীলুল মাওয়ায়েজ : ৩/১১৭

আল্লাহ তাআলা শোকর ও সবরের নেয়ামতে আমাদেরকে ধন্য করুন। আল্লাহ আমাকে যে পরিবার, পরিবেশ, খাবার, পোশাক ও ঘর দিয়েছেন তাতেই শোকর ও সবরের সঙ্গে কাটানোর তাওফীক দিন।  সন্তানদেরও শোকর ও সবরের শিক্ষা দিই। কোনো অভিযোগ—অনুযোগ না করি। আল্লাহ আমাদের সুখী করুন। আমীন।

 

লেখক সম্পর্কে
Avatar

editor

একটি কমেন্ট করুন