সুখের নীড়
মোল্লা সাবেত খান
তাক্বওয়া ও মহব্বতের বন্ধন
মানুষকে আল্লাহ তাআলা কিছু বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এ বৈশিষ্ট্য তার সৃষ্টিগত ও প্রকৃতিগত। মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের একটি হলো মোহ ও আকর্ষণ। এ মোহ হতে পারে সম্পদের প্রতি, হতে পারে প্রভাব—প্রতিপত্তি ও সম্মানের প্রতি, হতে পারে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি। কোরআনে পাকে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
زُیِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوٰتِ مِنَ النِّسَآءِ وَالْبَنِیْنَ وَالْقَنَاطِیْرِ الْمُقَنْطَرَۃِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّۃِ وَالْخَیْلِ الْمُسَوَّمَۃِ وَالْاَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ؕ ذٰلِکَ مَتَاعُ الْحَیٰوۃِ الدُّنْیَا ۚ وَاللهُ عِنْدَهٗ حُسْنُ الْمَاٰبِ ﴿۱۴﴾
মানুষের জন্য মনোরম করে দেওয়া হয়েছে প্রবৃত্তির চাহিদা মোতাবেক বিষয়ের প্রতি আকর্ষণকে, তথা নারী, সন্তান, রাশিকৃত স্বর্ণ—রুপা, চিহ্নিত ঘোড়া, চতুষ্পদ জন্তু ও খেত—খামার। এসব পার্থিব জীবনের ভোগসামগ্রী। আল্লাহর কাছেই সুন্দর পরিণাম।—সূরা আলে ইমরান, ০৩ : ১৪
আল্লাহ তাআলা মানুষকে নারী, সন্তান, সম্পদ, খেত—খামার ইত্যাদির প্রতি আকর্ষণ দিয়েই সৃষ্টি দিয়েছেন। কারণ, এসবের প্রতি আকর্ষণ না থাকলে পৃথিবীর ব্যবস্থাপনা স্বাভাবিক গতিতে চলবে না। সম্পদের আকর্ষণের কারণে মানুষ ব্যবসা—বাণিজ্য, খেত—খামার ও চাকরি করে। স্ত্রী ও সন্তানের আকর্ষণে মানুষ ঘর বাধে। পরিবারের জন্য কষ্ট স্বীকার করে। এ টান ও ভালোবাসার কারণে মা তিলে তিলে সন্তানকে বড় করেন। বাবা সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে স্ত্রী—সন্তানদের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করেন। এ ছাড়া আরেকটি বড় কারণ—বরং বলা ভালো এটাই প্রধান কারণ—আর তা হলো মানুষকে পরীক্ষা করা। দুনিয়ার এ সকল মোহের ভেতরেও কে দ্বীন—শরীয়ত মোতাবেক জীবন পরিচালিত করে আর কে পার্থিব জগতের মোহে পরকালকে ভুলে বসে, তা পরীক্ষা করেন আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন।
ইসলাম হলো স্বভাব ও প্রকৃতির ধর্ম। স্বভাবজাত কোনো বিষয়কে ইসলাম এড়িয়ে যায়নি। পার্থিব জীবন থেকে পলায়ন করে বৈরাগ্যবাদ গ্রহণ করাকেও পছন্দ করেনি; বরং ইসলাম মানুষের স্বভাবজাত এ সকল চাহিদা পূরণের জন্যে হালাল ও জায়েয উপায় বাতলে দিয়েছে। জায়েয পদ্ধতিতে ব্যবসা—বাণিজ্য করাকে ইসলাম উৎসাহিত করেছে। হাদীস শরীফে এসেছে,
التاجر الصدوق الأمين مع النبيين والصديقين والشهداء
সত্যবাদী আমানতদার ব্যবসায়ী কাল কেয়ামতের দিন নবী, সিদ্দীক ও শহীদগণের সঙ্গে থাকবে।—জামে তিরমিযী :
তিনি বলেছেন,
النكاح من سنتي فمن لم يعمل بسنتي فليس مني
বিয়ে করা আমার আদর্শ। যে আমার আদর্শ থেকে বিমুখ হয় সে আমার দলভুক্ত নয়।—সুনানে ইবনে মাজাহ :
আরও বলেছেন,
ثَلاثَةٌ حَقٌّ عَلَى اللَّهِ عَوْنُهُمْ : الْمُجَاهِدُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ، وَالْمُكَاتَبُ الَّذِي يُرِيدُ الْأَدَاءَ، وَالنَّاكِحُ الَّذِي يُرِيدُ الْعَفَافَ
তিন ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা অবশ্যই সাহায্য করবেন। তারা হলো,
১. আল্লাহর পথে সংগ্রামী মুজাহিদ।
২. আযাদী চুক্তিবদ্ধ গোলাম, যে তার পণ আদায় করতে চায়।
৩. পবিত্রতার মানসে বিবাহ—বন্ধনে আবদ্ধ ব্যক্তি।—জামে তিরমিযী :
তিনি আরও বলেছেন,
وَلَسْتَ تُنْفِقُ نَفَقَةً تَبْتَغِي بِهَا وَجْهَ اللَّهِ إِلَّا أُجِرْتَ بِهَا حَتَّى اللُّقْمَةَ تَجْعَلُهَا فِي فِي امْرَأَتِكَ
তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে যে সদকাই করবে তাতেই সওয়াব লাভ করবে। এমনকি তোমার স্ত্রীর মুখে খাবার তুলে দিলেও (সওয়াব লাভ করবে)।—সহীহ বুখারী :
তো বিয়ে হলো মানুষের জৈবিক চাহিদা পূরণের বৈধ উপায়। এর দ্বারা পৃথিবীতে বৈধ পন্থায় মানব—বংশ সংরক্ষণ ও বৃদ্ধির ব্যবস্থা যেমন হয় তেমনই পৃথিবী রক্ষা পায় চরম বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতা থেকে। তাই ইসলাম মানবজাতির সূচনা থেকেই এ পারিবারিক বন্ধনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে। পারিবারিক এ বন্ধন যেন অটুট থাকে, সুন্দর ও সুখময় হয় সে লক্ষ্যেই শরীয়ত কতৃর্ক বেশ কিছু বিধান দেওয়া হয়েছে। একের সাথে অন্যের কিছু হক ও প্রাপ্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে কেবল হক ও অধিকার আদায় করলেই এ বন্ধন পূর্ণ শান্তিময় হবে না; বরং পারস্পরিক মহব্বত ও আস্থাও জরুরি।
শাইখুল ইসলাম আল্লামা শিব্বীর আহমদ উসমানী রহ. বলেন, স্বামী—স্ত্রীর মধ্যে দুটি গুণ থাকলে দুনিয়াতেই সে পরিবারে জান্নাতের সুখ নেমে আসবে। গুণ—দুটির অভাব হলে পরিবারটি দুনিয়াতেই জাহান্নামের অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হবে। গুণ দুটি হলো তাকওয়া ও মহব্বত। তাকওয়া ও মহব্বতের বন্ধনেই একটি পরিবার জান্নাতের সুখ লাভ করতে পারে। যে সুখের কাঙাল আজ তথাকথিত উন্নত পৃথিবী।
প্রথম হলো তাকওয়া। আল্লাহর ভয়ে সব ধরনের গোনাহ ও অন্যায় থেকে বিরত থাকার প্রেরণাই হলো তাকওয়ার সহজ—সরল মর্ম। একজন মানুষ যখন তাকওয়ার আলোয় উদ্ভাসিত হয় তখন তার জীবনের রংই হয় ভিন্ন। একজন মুত্তাকী মুসলমান শরীয়তের সকল নির্দেশনা মেনে চলে বিধায় তার দ্বারা কোনো অন্যায় সংঘটিত হয় না। সে কাউকে কষ্ট দেয় না। কারও ক্ষতি করে না। সকলের কল্যাণকামী হয়। তাকওয়ার প্রেরণায় যে জীবন গড়ে ওঠে তা—ই একজন প্রকৃত মুসলমানের জীবন। এক হাদীসে যে বিষয়টি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে বলেছেন,
الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ
প্রকৃত মুসলমান সে—ই যার মুখ ও হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।—সুনানে আবু দাঊদ :
মানুষ সাধারণত মুখ ও হাতেই অন্যকে কষ্ট দেয়, তাই এ দুটি অঙ্গের কথা বলা হয়েছে। একজন মুসলমানের লেনদেন ও আচার—ব্যবহার সাধারণত মুসলমানের সঙ্গেই বেশি হবে তাই মুসলমানের কথা বলা হয়েছে। না হয় মূল কথা হলো, যেকোনো ভাবে যে—কাউকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত যে থাকে সে—ই প্রকৃত মুসলমান। অতএব একজন মুত্তাকী মুসলমান বাবা, মা, স্ত্রী, সন্তান তো দূরের কথা, কোনো একটি দুর্বল প্রাণীকেও কষ্ট দিতে পারে না।
যার সঙ্গে মানুষের সময় বেশি কাটে তার সঙ্গেই হক, অধিকার ও প্রাপ্যের প্রসঙ্গ বেশি থাকে। আমাদের সমাজ—জীবনের মূল ভিত্তি হলো পরিবার। পরিবারের ভিত্তিমূল স্বামী—স্ত্রী। স্বামী—স্ত্রীর বন্ধন যত মজবুত ও দৃঢ় হবে পারিবারিক বন্ধনও ততটা দৃঢ় হবে। আর দুজনের সম্পর্ক সুদৃঢ় ও প্রীতিময় করতে হলে প্রথমেই যে বিষয়টির প্রয়োজন তা হলো একে অন্যের হক আদায়ে সচেষ্ট হওয়া। হক ও অধিকার লঙ্ঘন থেকেই শুরু হয় সম্পর্কের টানাপোড়েন। পরিবার জীবনে ইসলাম স্বামী—স্ত্রী উভয়ের উপরই কিছু কর্তব্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। একতরফা স্বামীর উপরও নয় আবার একতরফা স্ত্রীর উপরও নয়। এখন অধিকার আদায়ে মানুষ যত্নবান হওয়ার জন্য প্রথমেই যে বিষয়টি প্রয়োজন তা হলো তাকওয়া ও খোদাভীতি। যে আল্লাহকে ভয় করে সে কখনো অন্যের অধিকার খর্ব করতে পারে না। তাই সভ্য সমাজ গড়ে তুলতে হলে, সবার অধিকার নিশ্চিত করতে হলে প্রথম প্রয়োজন তাকওয়ার। তবে পারিবারিক জীবনে তাকওয়ার গুরুত্বটা একটু বেশিই। যার কারণে বিয়ের খুতবায় রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোরআনে কারীমের যে তিনটি আয়াত তিলাওয়াত করতেন তার সবক’টিই তাকওয়া প্রসঙ্গে।
یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اتَّقُوْا رَبَّكُمُ الَّذِیْ خَلَقَكُمْ مِّنْ نَّفْسٍ وَّاحِدَۃٍ وَّخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا کَثِیْرًا وَّنِسَآءً ۚ وَاتَّقُوا اللهَ الَّذِیْ تَسَآءَلُوْنَ بِهٖ وَالْاَرْحَامَ ؕ اِنَّ اللهَ کَانَ عَلَیْكُمْ رَقِیْبًا ﴿۱﴾
হে লোকসকল, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় করো, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এক ব্যক্তি থেকে। তার থেকেই সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে। আর তাদের উভয় থেকে তিনি বহু পুরুষ ও নারীর বিস্তার করেছেন। ভয় করো আল্লাহকে, যার ওসিলা দিয়ে তোমরা একে অপরের কাছে নিজেদের হক চেয়ে থাকো এবং আত্মীয়দের (অধিকার খর্ব করাকে) ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি লক্ষ রাখেন।—সূরা নিসা, ০৪ : ০১
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ حَقَّ تُقٰتِهٖ وَلَا تَمُوْتُنَّ اِلَّا وَاَنْتُمْ مُّسْلِمُوْنَ ﴿۱۰۲﴾
ওহে যারা ঈমান এনেছ, আল্লাহকে যথাযথ ভয় করো। মুসলমান অবস্থা ব্যতীত মৃত্যুবরণ করবে না।—সূরা আলে—ইমরান, ০৩ : ১০২
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَ قُوْلُوْا قَوْلًا سَدِیْدًا ﴿ۙ۷۰﴾ یُّصْلِحْ لَكُمْ اَعْمَالَكُمْ وَیَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ ؕ وَمَنْ یُّطِعِ اللهَ وَ رَسُوْلَهٗ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِیْمًا ﴿۷۱﴾
ওহে যারা ঈমান এনেছ, আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্য কথা বলো। তিনি তোমাদের কাজকর্ম দুরস্ত করে দেবেন এবং তোমাদের গোনাহ ক্ষমা করবেন। যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অনুসরণ করে সে অবশ্যই বিরাট সফলতা লাভ করবে।—সূরা আহযাব, ৩৩ : ৭০, ৭১
উল্লিখিত আয়াত তিনটি বিয়ের খুতবায় পাঠ করা সুন্নত। আয়াত তিনটির মধ্যেই তাকওয়া ও খোদাভীতির কথা বলা হয়েছে। কেবল প্রথম আয়াতটির একাংশে হযরত আদম ও হাওয়া আলাইহিমাস সালাম—এর সৃষ্টি ও তাদের মানব—বংশ বিস্তারের প্রসঙ্গ এসেছে। বোঝা গেল বৈবাহিক জীবনে তাকওয়ার গুরুত্ব অনেক বেশি। তাকওয়ার প্রভাবেই একে অপরের হক ও অধিকার রক্ষার প্রতি যত্নবান হতে পারে পরিপূর্ণভাবে। তবে কেবল হক ও অধিকারের হিসাব—নিকাশেই একটি সংসার সুখী হতে পারে না। আইন—কানুন ও ধরা—বাঁধা নিয়ম—নীতির ছকে একটি বন্ধনকে আবদ্ধ করা যায় না। তাই দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পারস্পরিক মহব্বত।
পরিবারের প্রতিটি সদস্যের অন্তরে খোদার ভয়—ভীতি থাকলেই সকলের প্রাপ্য—হক আদায় সম্ভব হবে। তখন মা—বাবা সন্তানের হক আদায় করবে। সন্তানরা পিতা—মাতার হক আদায় করবে। তেমনি তাকওয়া অন্তরে থাকলে স্বামী স্ত্রীর হক আদায় করবে। স্ত্রীও স্বামীর হক আদায় করবে। কারণ, তাকওয়া গুণে গুণান্বিত হওয়ার কারণে সকলের মনেই এ কথা জাগ্রত থাকবে, যদি আমি আমার উপর অর্পিত হক আদায় না করি তাহলে আখেরাতে আল্লাহ তাআলার সামনে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। অপরদিকে প্রত্যেকের অন্তরে অপরের প্রতি মহব্বত—ভালোবাসা থাকলে তার প্রতি ইহসান করা সম্ভব হবে। পরিবারের সকলেরই একে অন্যের সহযোগিতা নিতে হয়। এ মহব্বত ও ভালোবাসার টানেই পারিবারিক এ বন্ধন দৃঢ় হয়ে উঠবে। যে স্বামী—স্ত্রীর মাঝে তাকওয়া ও পরস্পর মহব্বত রয়েছে, যারা ইনসাফ ও ইহসানের হুকুম মেনে চলছে, তাদের পরিবারে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের অভাব হতে পারে, সুখ—শান্তির অভাব হবে না। পক্ষান্তরে এ দুটি গুণ না থাকলে পরিবারে দুনিয়ার সবকিছু থাকলেও সুখ থাকবে না।
তাকওয়া ও মহব্বত গুণ—দুটির মধ্যে তাকওয়া প্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। কেবল মহব্বত ও ভালোবাসার ভিত্তির উপর এ গুরুত্বপূর্ণ বন্ধন দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। এ বিষয়টি সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে না পারার কারণেই সংসার অশান্তির অনলে পুড়তে থাকে। একই ছাদের নিচে দুজন স্বামী—স্ত্রী বসবাস করলেও মনের দিক থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করে। বিয়ের আগে প্রেমের সম্পর্ক করে মধুর ও সুখময় একটি সংসারের রঙিন স্বপ্ন দেখে কত যুবক—যুবতী। কিন্তু বিয়ের অল্প ক’দিন পরই অশান্তি শুরু হয়; বরং সমাজের একটি বাস্তব চিত্র হলো প্রেমের বিয়ে বেশিদিন টেকে না বা সে সংসারের সুখ স্থায়ী হয় না। এখানে তারা প্রথমেই যে ভুলটি করেন তা হলো সংসার জীবনের সুখ—সমৃদ্ধির ভিত্তিমূল তাকওয়াকে ডিঙিয়ে মহব্বতের সরোবরে হাবুডুবু খান। মহব্বত বা ভালোবাসা একটি আবেগের নাম। মনের একটি অবস্থার নাম। মানুষের মনের অবস্থা যেকোনো সময় পরিবর্তন হতে পারে। আবার এ মহব্বতের কারণে একে অপরের কাছে এতটাই দাবি ও আবদার করে বসতে পারে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তো মহব্বত ও ভালোবাসা যদি তাকওয়ার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত না হয় তাহলে তা হেঁাচট খাবেই। তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, বিশেষ করে পারিবারিক জীবনে তাকওয়ার প্রতি খুব বেশি গুরুত্বারোপ করতে হবে।
দুনিয়ার সবকিছু আইন—আদালত দিয়ে আদায় করা সম্ভব হলেও সুখ লাভ করা যায় না। ধরুন আইন—আদালতের মাধ্যমে স্ত্রী স্বামী থেকে তার প্রাপ্য মহরানা, হাত—খরচ, সম্মানজনক জীবন—উপকরণ সবই লাভ করল। কিন্তু স্বামী তাঁর সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলে না। মহব্বত ও ভালোবাসার আবেগে কোনো কথা বলে না। সাধারণ প্রয়োজন সবই পূরণ করে। বলুন, এর জন্য কি আদালতের দ্বারস্থ হওয়া যাবে? প্রশাসন চাপ প্রয়োগ করে কি হাসি ফোটাতে পারবে? কেবল এ একটি বিষয় যদি পরিবারে না থাকে, আর সবই থাকে তাহলে সে পরিবারে সুখ আসবে কোথা থেকে?
মুসলিমবিশ্বের একজন খ্যাতনামা দার্শনিক আলেম হলেন শায়েখ আলী তানতাভী রহ.। শায়েখের একটি লেখা থেকে দীর্ঘ উদ্ধৃতি তুলে ধরছি। শায়েখ নিবন্ধটি লিখেছিলেন এক ছেলের চিঠির জবাবে। ছেলেটির অভিযোগ ছিল, সে এক মেয়েকে খুব ভালোবাসত। মেয়েটিও তাকে চাইত। কিন্তু মেয়ের বাবা মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দিয়েছে। শায়েখ লেখেন :
‘ধরো তুমি ব্যবসায়ী। তোমার কাছে কেউ এসে বলল, আল্লাহর কসম, এই পণ্যটি আমার খুব পছন্দ। এটি আমার মন—মস্তিষ্ক জুড়ে আছে। রাত জেগে জেগে আমি একে নিয়ে ভাবি।
এ কথা শুনে কি তুমি বিনামূল্যে পণ্যটি তাকে দিয়ে দেবে?
আমার উদাহরণ শুনে হয়তো তুমি বলবে, মেয়ে তো আর পণ্য নয়। বিয়েও কোনো বেচাকেনা নয়। উপরন্তু ওই পণ্যটি একধরনের বস্তু আর মেয়েটি একজন মানুষ, যার হৃদয় আছে। আবেগ—অনুভূতি আছে। যে আমাকে মনেপ্রাণে ভালোবাসে যেমন আমি তাকে ভালোবাসি…।
তুমি হয়তো জানো না, এই বয়সের মেয়েদের হৃদয় থাকে একেবারেই কাঁচা। মাত্র প্রেম ও আবেগ অনুভব করতে শুরু করে। ফলে প্রথম যে যুবক তার কল্পনায় এসে দাঁড়ায় তাকে নিয়েই সে ভাবতে শুরু করে। কেবল এই সূত্রেই হয়তো তুমি মেয়েটির কল্পনায় জায়গা করে নিয়েছ।
এই বয়সে তো কখনো দেখা যায়, ছেলে—মেয়ের জাত—পাত ভিন্ন। চেহারা—আকৃতি ভিন্ন। এই সবকিছু উপেক্ষা করে তারা একে অপরকে ভালোবেসে ফেলে। এবং…
কখনো ছেলেটি হয় নিছক সতীত্ব চোর। যার সকল ধ্যান থাকে মেয়েটিকে একটু চেখে দেখা। এরপর হারিয়ে যাওয়া। এ ধরনের ছেলে যদি আবেগের টানে মেয়েটিকে বিয়ে করে বসে, অল্প ক’দিনের মধ্যেই সে প্রেমাবেগ বিদ্বেষে রূপ নেয়। তখন তার সঙ্গে মেয়েটির জীবন হয়ে ওঠে ‘দুনিয়ার জাহান্নাম’।
এমন ছেলের উদাহরণ ওই ব্যক্তি, যার প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছে। তাই ডাল আর আটার খিচুড়ি দেখেই অস্থির। সামান্য খাওয়ার পর কিছুটা ক্ষুধা দূর হলে সামনে এল বিরিয়ানি। কিংবা বার্গার—সেন্ডউইচ। সুস্বাদু কোনো মিষ্টান্ন অথবা অন্য যেকোনো ভালো খাবার। তখন সে আর ওই খিচুড়ির দিকে ফিরে তাকাতেই পারে না। অথচ একসময় কী প্রচণ্ড আগ্রহই—না ছিল এর প্রতি!
একবার আল—আইয়্যাম পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে আমাকে বিয়ে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো—বিয়ে কি ভালো লাগা—ভালোবাসার ভিত্তিতে হবে নাকি ভবিষ্যৎ—কল্যাণ বিবেচনা করে?
আমি বললাম, বিয়ে কেবল প্রেম ও ভালোবাসা কেন্দ্র করে হলে তা হয় ওই ঘরের মতো, যা পানির নালায় স্তূপ করে রাখা লবণের ওপর তৈরি করা হয়েছে।
প্রেম—ভালোবাসা মাদকের মতো। প্রেমিক হয় মাদকাসক্ত। ফলে কুৎসিত প্রেমাস্পদকেও সে সুন্দর দেখে। তার ত্রুটিগুলোও মনে করে গুণ—যোগ্যতা। এরপর যখন নেশা দূর হয়ে যায়, মস্তিষ্ক কাজ করতে শুরু করে তখন তার ত্রুটিগুলোর বিষয়ে সতর্ক হয়। বাস্তব অবস্থা দেখার পর তাকে অপছন্দ করতে শুরু করে। এ ধরনের বহু ঘটনা আমার জানা আছে। তা ছাড়া পাশ্চাত্য লেখকদের অসংখ্য লেখা আমার পড়া হয়েছে। তাতে চিত্রায়িত হয়েছে—কীভাবে একান্ত মিলন প্রেমিকের চোখ থেকে প্রেমের আবরণ সরিয়ে দেয়। ফলে ‘মধুময়’ একটি মাস যেতে—না—যেতেই শুরু হয়ে যায় ‘খেজুর—রসে’র বছর। এরপর কয়েক বছর থাকে শুধু ‘সিরকা’। সে সিরকা রূপান্তরিত হয় আলকাতরায়। একসময় তা হয়ে যায় প্রাণনাশক বিষ!
দুই যুগেরও বেশি সময় আগের কথা। এক সেমিনারে আমি বলেছিলাম, ইতিহাসখ্যাত লায়লার প্রেমিক মজনু (তার স্তরের কোনো প্রেমিকের সন্ধান আছে আপনাদের কাছে?) লায়লাকে বিয়ে করলে এক বছর যেতে—না—যেতেই তাদের মাঝে কলহ শুরু হয়ে যেত। দুই বছর পার হতে না হতেই বাসা বাঁধত বিরক্তি ও ঘৃণা। তৃতীয় বছরের শেষে অবশ্যই দাবি উঠত বিচ্ছেদের।
নিশ্চিত জেনে রাখুন, নিছক প্রেম কখনোই বিয়ের ভিত্তি হতে পারে না। ভিত্তি মনে করে কেবলই উন্মাদ যুবকেরা। ভিত্তি ধরা হয় গল্প আর সিনেমায়। [উঠতি বয়সীদের প্রেম ও বিয়ের প্রস্তাব, মাসিক নেয়ামত, অক্টোবর ২০১৯]
বোঝা গেল, তাকওয়াই হলো সংসার—জীবনের প্রধান ভিত্তি। তাকওয়ার ভিত্তিতে যে মহব্বত ও ভালোবাসা জন্মায় তাতে কোনো খাদ থাকে না। অতএব তাকওয়া ও তাকওয়া—ভিত্তিক মহব্বতের বন্ধনে আমাদের পরিবার হয়ে উঠুক সুখের নীড়।