হাকীমুল উম্মতের দরবারে সায়্যিদ সুলাইমান নদভী
মাওলানা যায়েদ মাজাহেরী নদভী
অনুবাদ : মাওলানা আব্দুল মুমিন
[পূর্বপ্রকাশের পর]
হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ.—এর সঙ্গে সায়্যিদ সুলাইমান নদভীর প্রথম সাক্ষাৎ
তাযকিরায়ে সুলাইমান—এর লেখক ড. গোলাম মুহাম্মদ সাহেব বলেন,
১৯৩৪ সালের শেষ এবং ১৯৩৫ সালের শুরুর দিকের কথা। আল্লামা ইকবাল মরহুমের আমন্ত্রণে হযরত সায়্যিদ সাহেব কোনো কমিটিতে যোগদান করতে লাহোর গমন করলেন। তখন পর্যন্ত হযরত থানভী রহ.—এর সঙ্গে সায়্যিদ সাহেবের সাক্ষাৎ হয়নি। তিনি ভাবলেন, লাহোর থেকে ফেরার সময় থানাভবন নামবেন। সে সফরে তাঁর ইচ্ছা পূরণ হলো। মুর্শিদ থানভী রহ.—এর দর্শন লাভ হলো। সে সাক্ষাতে স্বয়ং শায়খ (হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী) রহ. যে অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন, তা তাঁরই সুপরিমিত আবেগঘন ভাষায় শুনুন। হযরত থানভী রহ. মাওলানা দরিয়াবাদী রহ.—এর উদ্দেশে এক চিঠিতে লেখেন,
মাওলানা সায়্যিদ সুলাইমান নদভী হঠাৎ করেই তাশরীফ আনলেন। আমি ঘরেই ছিলাম। শুনতে পেয়েই উপস্থিত হলাম। আমার ধারণা ছিল তিনি দীর্ঘ ও সুঠাম দেহের অধিকারী হবেন। কিন্তু মধ্যম গড়নের দেখে খুবই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলাম। এরপর সাক্ষাৎ ও কথাবার্তায় তাঁর বিনয়, সরলতা ও মজলিসের সঙ্গীর প্রতি শিষ্টাচার দেখে তো আমি অভিভূত হয়ে গেছি।[1] ১১ টায় এসেছেন, ৩টায় বিদায় নিয়েছেন। মজলিসে দীর্ঘ সময় প্রশংসা করছিলেন।[2]
আল্লামা সায়্যিদ সুলাইমান নদভী রহ. কেন গিয়েছিলেন হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রহ.—এর দরবারে
হায়াতে সুলাইমান—এর লেখক শাহ মুঈনুদ্দীন রহ. লেখেন,
প্রকৃত অর্থে তাসাওউফ ও সুলূক ওই বিষয়ই, যাকে কোরআন ও হাদীসে ‘ইহসান’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। এটা আমলের মধ্যে ইখলাস ও নিষ্ঠার এমন এক অবস্থা যা কেবল কিতাবপত্র পড়ে অর্জিত হয় না। এর জন্য কোনো দিলওয়ালা বুযুর্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন, সান্নিধ্য গ্রহণ ও রিয়াজত—মুজাহাদার প্রয়োজন রয়েছে। আজ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর সকল হাদীস কিতাবাদিতে সংরক্ষিত আছে। হাদীসগুলো আমাদের নজরে রয়েছে। অধিক হাদীস বর্ণনাকারী বড় বড় সাহাবীর চেয়েও বেশি পরিমাণ হাদীস একেকজন মুহাদ্দিসের মুখস্থ আছে। এর দ্বারা প্রত্যেকে নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী উপকৃতও হচ্ছেন। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর অল্প কদিনের সোহবত ও সান্নিধ্য সাহাবায়ে কেরামের মাঝে যে প্রভাব সৃষ্টি করেছিল, সমগ্র হাদীস—ভান্ডার মুখস্থ করেও সে প্রভাব অর্জন করা সম্ভব নয়।
সাহাবায়ে কেরামের সংখ্যাও ছিল কয়েক লাখ। সাহাবী হিসেবে তাঁদের মর্যাদা ও সম্মান তো সকলের শিরোধার্য। তারপরও তাঁদের মধ্যে যার যতটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর নৈকট্য ও সম্পর্ক ছিল তিনি ততটা রাসূলের ইহসানী কাইফিয়ত লাভ করেছেন। এ কারণেই পরবর্তী সময়ের সাহাবায়ে কেরাম প্রথম পর্যায়ের মুহাজিরগণের সমমর্যাদার নন। তাঁদের মধ্যে আবার আশারায়ে মুবাশশারার বিশেষ মর্যাদা রয়েছে।
অতএব রাসূলের যুগে যখন ইহসানী কাইফিয়ত অর্জনের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর সোহবতের প্রয়োজন ছিল তখন এ যুগে—যখন মুসলমানদের দ্বীনি রুহ—চেতনা একেবারে দুর্বল হয়ে পড়েছে, অন্তরের ওপর হাজারো আবরণ পড়ে গিয়েছে তখন—কোনো শায়খের সোহবত তার চেয়েও বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। এতে যে কাইফিয়ত ও অবস্থার সৃষ্টি হয় তা শুধু কিতাব পড়ে অর্জিত হয় না। এই কাইফিয়ত ও বিশেষ অবস্থা অর্জনের মহান লক্ষ্যে বড় বড় ইমাম স্ব স্ব যুগের শায়খের শরণাপন্ন হয়েছেন।
অতএব সায়্যিদ সাহেব যদি (হাকীমুল উম্মত হযরত) মাওলানা আশরাফ আলী (থানভী রহ.)—এর শরণাপন্ন হয়ে থাকেন তাতে তাঁর ইলমী মর্তবা ও জ্ঞান—গরিমার কী ক্ষতি হয়ে যায় শুনি!—হায়াতে সুলাইমান : ৬৮৬
শায়খের সন্ধানে আল্লামা সায়্যিদ সুলাইমান নদভী রহ.—এর ব্যাকুলতা
হযরতওয়ালার মূল আকর্ষণ ও আগ্রহ ছিল হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ.—এর প্রতি। কিন্তু তিনি তখন এ নশ্বর জগতে ছিলেন না। তাই শায়খের অনুসন্ধানের বিষয়টি সমাধানহীন জটিল বিষয়ে পরিণত হয়। তিনি নিজেই বলতেন, পূর্ণ দশটি বছর চুপে চুপে হিন্দুস্তান থেকে আরব পর্যন্ত নজর ফেরাতে থাকি। কিন্তু এমন কোনো ব্যক্তিত্ব দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল না, যিনি আমার ব্যথার উপশম করতে পারেন। কিছু বুযুর্গ পেয়েছি তবে তাদের সঙ্গে তবীয়তের মিল হয়নি। বারবার এ চিন্তাই আসত, হায় যদি হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ সাহেব জীবিত থাকতেন।—তাযকিরায়ে সুলাইমান : ৯৩
আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশনা ও গায়বী সাহায্য
এক রাতে সায়্যিদ সাহেব স্বপ্নে শায়খুল আরব ওয়াল আজম হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ.—এর সাক্ষাৎ লাভ করলেন। আমাদের সায়্যিদ সাহেব (মাওলানা সুলাইমান নদভী রহ.) প্রথমে তর্জনী দিয়ে নিজের বুকের দিকে ইঙ্গিত করেন। পরে হযরত হাজী সাহেব রহ. এর ফয়জের ভান্ডার বুকের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন,
اس کو ایسا کر دی جئے
এটাকে এমন করে দিন।
হাজী সাহেব রহ. মুচকি হেসে বললেন,
اب تو میں ایسا نہین کرتا
আমি তো এখন আর এমন করি না।
হযরতওয়ালা (আল্লামা সুলাইমান নদভী রহ.) বলেন, ঘুম ভাঙতেই এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা এমন মনে হলো যে, হযরত হাজী সাহেব রহ.—এর সঙ্গে যেহেতু এ নশ্বর জগতের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছে, তাই তার ওজর আছে। অতএব, আমাকে তাঁর কোনো স্থলাভিষিক্তের সঙ্গে সম্পর্ক জুড়তে হবে।
ওই সময় হিন্দুস্তানে হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ.—এর বিশিষ্ট খলীফা ছিলেন হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ.। তাঁর বরকতময় সত্তার মাধ্যমেই খানকায়ে ইমদাদিয়া থানাভবন সেই কেন্দ্রীয় মর্যাদায় ভূষিত হয়েছিল, যে মর্যাদা হিজরী ১১ শতাব্দীর সূচনাকালে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহ.—এর পবিত্র সত্তার কারণে লাভ করেছিল সেরহিন্দ। তাই অনিবার্যভাবেই হযরতওয়ালার তনু—মন হযরত থানভীর প্রতিই আকৃষ্ট হয়। সে আকর্ষণ তাকে হযরত থানভীর শরণাপন্ন হতে বাধ্য করে।
মোটকথা বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক সকল দিক বিবেচনায় হযরতওয়ালার অনুসন্ধানী দৃষ্টি হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ.—কেই গ্রহণ করার ছিল, এরই মধ্যে সুস্পষ্ট ও সত্য একটি স্বপ্ন দেখলেন। হযরত দেখলেন, একটি খাটে হযরত মাওলানা থানভী রহ. বসে আছেন। পাশেই আরেক খাটে হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.—এর সঙ্গে হযরত সায়্যিদ সাহেব বসে আছেন। হঠাৎ মাওলানা মাদানী বসা থেকে উঠে সায়্যিদ সাহেবের হাত ধরে পীর ও মুর্শিদ থানভী রহ.—এর খেদমতে পেশ করে বললেন,
ان کو میری طرف سے قبول فرما لیں
তাকে আমার পক্ষ থেকে গ্রহণ করে নিন।
—মাআরিফ, সুলাইমান সংখ্যা : ৬৮, ৬৯
মনে হয় এ বরকতময় স্বপ্ন দেখার পর হযরতওয়ালা আশ্বস্ত হন এবং হযরত থানভী রহ.—এর শিষ্যত্ব গ্রহণের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে ফেলেন।—তাযকিরায়ে সুলাইমান : ১২৬
বাইআতের দরখাস্ত
শায়খ ও মুরীদের মাঝে পূর্ণ মিল হয়ে যাওয়ার পর (যে মিল তাঁদের মাঝে খুব অল্প সময়েই হয়ে গিয়েছিল) হযরত সায়্যিদ সাহেব বলেন, আমি বাইআতের জন্য দরখাস্ত করলাম কিন্তু হযরত হাকীমুল উম্মত রহ. বললেন, ‘৫০টি চিঠি লিখে শেষ করুন, তারপর ইনশাআল্লাহ’।
এরপর বললেন, দৈনিক ১টি করে বা সকাল—সন্ধ্যায় লিখেও এ সংখ্যা পূরণ করতে পারেন।
হযরত মাওলানা থানভী রহ. নিয়ম—শৃঙ্খলার প্রতি খুবই যত্নবান ছিলেন। তাই বাইআতের আগে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পত্র যোগাযোগের শর্তারোপ করতেন।[3]
সায়্যিদ সাহেবের ক্ষেত্রেও সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী এ শর্ত তো জুড়ে দিয়েছিলেন ঠিকই, তবে দেখুন, প্রজ্ঞা ও মমতার মিশেলে নিয়ম ও মহব্বত উভয়ের দাবিকেই যুগপৎ জুড়ে দিয়েছেন। না এটা ভাঙে আর না ওটা ছুটে। হযরত সায়্যিদ সাহেব শর্ত কবুল করে নিলেন।
ہر چیز از دوست می ر سد نیکو ست
বন্ধুর পক্ষ থেকে যা কিছুই আরোপিত হয়, ভালোর জন্যই হয়।
—তাযকিরায়ে সুলাইমান : ১৩৭
থানাভবনের উদ্দেশে
১৯৩৮ সালের জুলাই মাসে মাওলানা আব্দুল বারী নদভী সাহেব থানাভবনে মুকীম ছিলেন। তখন তিনি বেশ জোর দিয়েই লিখলেন, ‘ব্যস, আমি থাকাকালেই হিম্মত করে চলে আসুন।’
তার এ পীড়াপীড়ির কারণ স্বয়ং মাওলানা নদভীর ভাষায় শুনুন,
পীড়াপীড়ির বিশেষ কারণ ছিল এই—হযরত (থানভী) রহ.—এর অসুস্থতা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছিল। আশঙ্কা হচ্ছিল, ইরশাদ ও তরবিয়তের এ সোনালি সূর্য না অস্তমিত হয়ে যায়।—মাআরিফ, সুলাইমান সংখ্যা : ৬৫, ৯৬
এদিকে হযরতওয়ালা তো আসারই ছিলেন। মাওলানাকে জবাবে লিখলেন, ‘আপনার পত্র পেয়েছি, আমি আপনার প্রতিটি শব্দের সঙ্গে একমত। আগামীকাল সকালে আলীগড়ের উদ্দেশে রওনা করছি। খুশি হলাম যে আপনি ২৫ আগস্ট পর্যন্ত ওখানে (থানাভবন) থাকবেন। ইনশাআল্লাহ শাহদরা লাইন রেলওয়েতে ১১ আগস্ট সন্ধ্যায় পৌঁছে যাব। দুদিন থাকব। আমার সামর্থ্য অনুযায়ী উপকৃত হব।’
প্রোগ্রাম অনুযায়ী হযরতওয়ালা সফর করলেন। নীরবে থানাভবন পৌঁছে গেলেন। কিন্তু হাকীমুল উম্মতের সঙ্গে এখানে সাক্ষাৎ হওয়া তাকদীরে ছিল না। হাকীমুল উম্মত তখন চিকিৎসার উদ্দেশে লখনৌ চলে গিয়েছিলেন।—তাযাকিরায়ে সুলাইমান : ১২৬
লখনৌতে মুর্শিদ থানভী রহ.—এর কাছে বাইআত
থানাভবনে হযরত থানভীকে না পেয়ে হযরতওয়ালা নদভী লখনৌ চলে গেলেন। লখনৌতে থানভী রহ. মৌলভী মুহাম্মদ হাসান কাকুরভীর বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। অসুস্থতার দরুন সাধারণ দেখা—সাক্ষাৎ বন্ধ ছিল। তবে বিশেষ ব্যক্তিবর্গ যেমন, খাজা আযীযুল হাসান রহ. প্রমুখের আগমনে নিষেধাজ্ঞা ছিল না। হযরত মাওলানা সায়্যিদ সুলাইমান নদভী রহ. বাইআতের উদ্দেশ্যে আগমন করেছেন জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গেই ডেকে পাঠালেন। তাঁর অনুরোধেই তরবিয়তের খেদমতের দায়িত্ব নির্দ্বিধায় গ্রহণ করলেন। এর মাধ্যমে দীর্ঘ দশ বছরের শায়খ অনুসন্ধানের বিষয়টি ১৯৩৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে এসে সফলতার মুখ দেখল।
جستجو آج وہاں پر مجھے لے آتے ہے
خود جہاں حسن محبت کا تماشائ ہے
আবেগময় অনুসন্ধান আমাকে আজ ওখানে নিয়ে এসেছে
খোদ সৌন্দর্য যেখানে ভালোবাসার বিমুগ্ধ দর্শক।
—তাযকিরায়ে সুলাইমান : ১২৭
জনাব ওয়াসল বেলগ্রামী সাহেব সফরনামায়ে লাহোর ও লখনৌ—তে লেখেন,
জনাব মাওলানা সুলাইমান নদভী না জেনে সফর করার কারণে হযরতওয়ালা থানভীর সাক্ষাতের জন্য থানাভবন গেলেন। যখন জানতে পারলেন হযরত লখনৌ গিয়েছেন তখন লখনৌ গমন করলেন এবং নিজের তামান্না পূরণ করলেন।—সফরনামায়ে লাহোর ও লখনৌ : ১১৪
মাওলানা আব্দুল মাজেদ দরিয়াবাদী রহ. লেখেন :
মাওলানা সায়্যিদ সুলাইমান নদভী ও মাওলানা মাসউদ আলী নদভীর নিয়মতান্ত্রিক বাইআতের সম্পর্ক হয়েছিল লখনৌতেই। যথাসম্ভব অক্টোবরের শুরুর দিকে।—হাকীমুল উম্মত : নুকুশ ও তাআসসুরাত : ৫৭৪
হাকীমুল উম্মত রহ. আগস্ট ১৯৩৮ এ চিকিৎসার জন্যে লখনৌ এসেছিলেন। হযরতওয়ালা নদভী এটাকে মহাসুযোগ মনে করে হযরতের খেদমতে উপস্থিত হয়ে শায়খের প্রতি পূর্ণ রুজু হয়ে বাইআতের মাধ্যমে ধন্য হন।—মাআরিফ, সুলাইমান সংখ্যা : ২৯০
সায়্যিদ সাহেবের বাইআত একটি আশ্চর্য ঘটনা এবং ফিকর ও আমলের দাওয়াতও বটে
সায়্যিদ সাহেবের এই বাইআত একটি আশ্চর্য ঘটনা ছিল। এতে বিনয়, নম্রতা, ইখলাস, সততা ও প্রতিভার মূল্যায়নের বহু দিক লুক্কায়িত আছে। এতে ফিকর ও আমলের দাওয়াতও আছে। সায়্যিদ সাহেব এ আধ্যাত্মিক পদক্ষেপ এমন সময় গ্রহণ করেছিলেন যখন তাঁর জ্ঞান—গরিমার সূর্য মধ্য আকাশে অবস্থান করছিল। ইকবালের মতো যুগশ্রেষ্ঠ আল্লামা তাকে ইসলামী জ্ঞানভান্ডারের ক্ষেত্রে جوئے شِیر کا فرہاد অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ তিনি বিপুল—বিস্তৃত ইসলামী জ্ঞান—ভান্ডার মন্থনের মতো অসাধ্য সাধনের সাধক; যেমন অসাধ্য সাধন করেছিল শিরীর জন্য দুধের নহর খননকারী ফরহাদ।—তারীখে নদওয়াতুল উলামা : ২/৪৮১
ভাব ও আবেগের শ্রোতধারা
আরেকটি বিশেষ অবস্থার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল দিলের তামান্নার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের পর। আর তা ছিল ভাব ও আবেগের প্রবাহ। যা হৃদয় থেকে উৎসারিত হয়ে জবানে আসত আর ছন্দ হয়ে প্রকাশ পেত। স্বয়ং ছন্দকার এতে বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলেন :
نغمہ اللہ سے طبع حزیں موزون ہوئی
جو کبھی گاتی نہ تھی وہ وجد میں گانے لگی
ব্যথিত হৃদয় আল্লাহ—প্রেমের সুরে ছন্দবদ্ধ হলো
কখনো যে কিছু গেয়ে দেখেনি, ভাবাবেগে সে—ই গেয়ে উঠল।
এরপর আরও বলেন,
فیض ہے یہ کسں ولی وقت کا
اب مرا جو شعر ہے الہام ہے
জমানার কোন সে ওলীর ফয়েজ এটা
এখন আমার যে কবিতা তা ইলহাম।
হযরতওয়ালার সত্য জবান থেকে এটাও শুনেছি, ‘আমার এ কাব্য—জীবনের সূচনা হয়েছিল হযরতওয়ালা (থানভী রহ.)—এর সঙ্গে সম্পর্কের পর। এর সমাপ্তিও ঘটে হযরতের বিদায়ের মাধ্যমেই। এরপর খুব চেষ্টার পর দু—চারটি গজল মনে এসেছিল। এর কারণ হলো হযরতের জীবদ্দশায় ভাবাবেগ উপচে পড়ত। এ অবস্থা পরে আর থাকেনি।’
এ বিষয়টির বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে এ কবিতায় :
جو شعر بھی سپرد قلم کر رہا ہوں میں
سب واردات عشق رقم کر رہا ہوں میں
دیوانہ گان عشق کو دے کر صلائے عام
آ راستہ یہ مجلس جم کر رہا ہوں میں
যে ছন্দই আমি কলমের কাছে অর্পণ করছি
তার সবই হলো প্রেমের আবেগ ও উচ্ছ্বাস
প্রেম—পাগলদের দিয়ে অবারিত দান
পানের জলসা আবার জমজমাট করে তুলছি আমি।
তাই এ সতর্কবাণীও উচ্চারণ করেছেন :
سمجھیں مرے کلام کو جو ہوش مند ہیں
مستی میری یہ بادۂ انگور کی نہیں
আমার এ কথা বুঝবে কেবল সচেতন ব্যক্তিরাই
আমার এ মত্ততা নেশার শরাবের কারণে নয়।
—তাযকিরায়ে সুলাইমান : ১৩৫
বাইআতের পর ভাবাবেগে রচিত
হযরত সায়্যিদ সাহেবের কয়েকটি পঙ্ক্তি
جس دن سے میرے دل میں تری یا دبسی ہے
ہر ایک کو میں تیرے سوا بھول گیا ہوں
عالم کے تماشے نہیں اب جاذب دل میں
ہر لذت ہستی کا مزا بھول گیا ہوں
ہر سمت نظر آتے ہیں ہر وقت وہ مجھ کو
دورئ مسافت کا گلہ بھول گیا ہوں
اب مسئلہ کشرت و وحدت کو میں سمجھا
پا کر تجھے سب تیرے سوا بھول گیا ہوں
حل جب سے ہوا فلسفۂ حسن حقیقت
ہر مسئلہ اے ذہن رسا بھول گیا ہوں
ہے آہ وسحرگاہ میں وہ ذوق لب و گوش
چنگ نئےو بربط کی صدا بھول گیا ہوں
যেদিন থেকে আমার হৃদয়ে প্রিয় তোমার স্মরণ গেঁথে গেছে
সেদিন থেকে তোমাকে ছাড়া সবই ভুলে গেছি।
পৃথিবীর কোনো চাকচিক্যই হৃদয়কে আকর্ষণ করে না
মজাদার সব বস্তুর স্বাদই আমি ভুলে গেছি।
সব দিকে সব সময় কেবল তাকেই নজরে পড়ে
সফরের দূরত্বের অভিযোগ আমি ভুলে গেছি।
আধিক্য ও একত্বের বিষয়টি এখন বুঝেছি
তোমাকে পেয়ে তুমি ছাড়া সব ভুলে গেছি।
হাকীকতের সৌন্দর্যের দর্শন যখন থেকে বুঝে এসেছে
হে প্রখর মেধা সব মাসআলাই ভুলে গেছি।
শেষ রাতের আহাজারিতে জবান ও কানের সে স্বাদ আছে
বাদ্য, বাঁশি ও বীণার সুর আমি ভুলে গেছি।
এ পঙ্ক্তিমালা হযরত থানভী রহ.—এর কাছে বাইআতের সপ্তাহ—দশ দিনের মধ্যে রচিত।[4] এ সময় তিনি যে ভাবাবেগের জগতে বিচরণ করছিলেন তার চিত্র এ ছাড়া অন্য কোনো পঙ্ক্তিমালায় এতটা সুন্দরভাবে ফুটে ওঠেনি।—মাআরিফ, সুলাইমান সংখ্যা : ২৩৩
লখনৌতে হযরত থানভী রহ.—এর সান্নিধ্যে চারদিন এবং তার পরের অনুভূতি
লখনৌতে হযরত থানভী রহ.—এর সান্নিধ্যে চারদিন অবস্থানের পর সায়্যিদ সাহেব যে অনুভূতি প্রকাশ করেছেন তা উল্লেখ করার মতো। বন্ধুবর মাওলানা আব্দুল বারী নদভীর কাছে এক চিঠিতে লেখেন :
‘লখনৌতে কেবল চারদিনের সান্নিধ্য লাভ করেছিলাম। মাওলানার (থানভী রহ.) স্নেহ—মমতা আমার ভক্তি—শ্রদ্ধা বৃদ্ধি করে চলেছে। অবশেষে তাঁরই নির্দেশে আর আপনার (মাওলানা আব্দুল বারী) পরামর্শ তো আগ থেকেই ছিল। চিঠিপত্রের যোগাযোগ, বাহ! দারুণ। আর এখন তো (আমার সর্বসত্তা জুড়ে) তিনি আর তিনি।
آتے ہیں نگاہوں میں خیالوں میں دلوں میں
معائنہ سے بڑھ کر تصور میں مکا لمے تک نوبت آتی ہے
সে আসে আমার দৃষ্টিতে, কল্পনায় ও হৃদয়পটে / মুখোমুখি দর্শনের পর্যায় পার হয়ে কল্পনায় কথাবার্তারও সুযোগ হয়।
تم میرے پاس ہوتے ہو گویا
جب کوئی دوسرا نہیں ہوتا
যখন কেউ না থাকে মনে হয় তুমিই আমার পাশে আছ।
যাই হোক, আমি তো সফর শুরু করেছি। মানযিলে পেঁৗছানো যার জিম্মাদারি তিনি পেঁৗছে দেবেন। দুআ করবেন।’—তাযকিরায়ে সুলাইমান : ১২৯
আফসোস এতদিন কেন উদাসীন ও বঞ্চিত ছিলাম
মাওলানা আব্দুল বারী নদভীর নামে এক চিঠিতে সায়্যিদ সাহেব লিখেছেন,
মাওলানার মাওয়ায়েজ ও কিতাবাদি পড়ছি। অধিকাংশ ইলমী মাসায়েল আমার নিজের রুচিমতোই পেয়েছি। এর দ্বারা হাল ও কাইফিয়তের নতুন নতুন গিট খুলে যায়। আফসোস, এতদিন কেন উদাসীন ও বঞ্চিত ছিলাম।
‘এতদিন কেন উদাসীন ছিলাম’—এর অনুভূতি সালেকের তলব চূড়ান্ত পর্যায়ের তীব্রতায় পেঁৗছে দেয়। এক জায়গায় শায়খকে লক্ষ করে বলেন,
ویرسے آیا ہوں ساقی دورسے آیا ہوں میں
ہو عطائے خاص مجھ کو جو عطائے عام ہے
অনেক দেরিতে এসেছি হে সাকী, বহুদূর থেকে
সাধারণ দানই যেন হয় আমার প্রতি বিশেষভাবে।
—তাযকিরায়ে সুলাইমান : ১৩০
বাইআতের পর সায়্যিদ সাহেবের অবস্থা
মাওলানা আব্দুল বারী নদভীর নামে লেখা এক পত্রে লেখেন,
দশ—বারো বছর যাবৎ যে বিষয় দর্শন বা নীতি হিসেবে বুঝে আসেনি তা হাতে—কলমে বুঝে এসেছে। এখন বিগত দিনের ক্ষতিপূরণে ব্যস্ত সময় পার করছি।
لعل الله يرزقنى صلاحا
হয়তো আল্লাহ আমাকেও নেকীর তাওফীক দান করবেন।
এখন না দারুল মুসান্নিফীনের সঙ্গে মনের তেমন টান আছে, না নদওয়ার সঙ্গে আর না ইলমী কোনো প্রবন্ধ, নিবন্ধ বা লেখালিখির সঙ্গে। যেহেতু আমার জীবিকা কলমের সঙ্গে জড়িত আর ঘরে কোনো পুঁজিও নেই, তাই নিরুপায় অবস্থায় পড়ে আছি। আল্লাহ হিম্মত দেন যেন সম্পর্কগুলো বর্জন করতে পারি।[5]—তাযকিরায়ে সুলাইমান : ১৩০; মাআরিফ, সুলাইমান সংখ্যা : ৯৫
মাওলানা আব্দুল বারী নদভীকে লেখা অপর এক চিঠিতে লেখেন,
আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করছি যেন বন্ধুদের মাঝেও সে আবহ সৃষ্টি হয় যা আপনি কামনা করেন। কিন্তু এ কথা তো স্পষ্টই যে আমার মধ্যে আর কী আছে, যা অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। হযরতের (হাকীমুল উম্মত থানভী রহ.) কথাগুলো তাদের শুনাই। তাঁর কিতাবাদির প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করি।
আমার রুচি ও উপলব্ধি বলে, যুগের শায়খ ওই সকল বিষয়ে নবীর স্থলাভিষিক্ত যে সকল বিষয় নবুওয়াতের সঙ্গে বিশেষিত নয়।—মাআরিফ, সুলাইমান সংখ্যা : ৯৭, ১০২
মোটকথা হৃদয়জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। চিন্তা ও দর্শনে পরিবর্তন এসেছে। নিজের এ অবস্থার চিত্র মাওলানা মাসউদ আলম নদভীকে লেখা এক চিঠিতে সংক্ষেপে তুলে ধরেছেন। চিঠির মর্মের পাশাপাশি ভাষার অলংকারও লক্ষ করুন,
‘ওয়াহ ওয়াহ’ এর স্বাদ তো অনেক আস্বাদন করেছি। অন্তর থেকে এ রং এখন বিদায় নিয়েছে। এখন তো ‘আহ আহ’ এর সময়। অতীতের ক্ষতির জন্য আহাজারি ও ভবিষ্যতের ফিকিরই এখন সামনে।
এই আহ আহ (অথার্ৎ অধিক পরিমাণে ইস্তেগফার ও যিকির) এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে দারুল মুসান্নিফীনের এক বন্ধু আমাকে বলেছেন, দারুল মুসান্নিফীনের দালান—কোঠায়ও এর প্রভাব ছেয়ে গিয়েছিল।—তাযকিরায়ে সুলাইমান : ১৩১
থানাভবন সফরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ
আল্লামা সায়্যিদ সুলাইমান নদভী রহ. মাওলানা আব্দুল মাজেদ দরিয়াবাদীকে লেখা এক চিঠিতে লেখেন,
আপনি কি থানাভবন যেতে পারেননি? আপনি তো কিছুই লিখলেন না। আপনি লিখেছিলেন, ‘যদিও মর্যাদা, কীর্তি, যুহদ ও তাকওয়া কিছুই নেই তবুও মেজাজ—তবিয়ত কম বুঝি না।’ কিন্তু এ অধম ও নগণ্য তো উভয় দিক থেকেই রিক্তহস্ত।
আমার সফরের বিবরণ আর কী। হাজির হয়েছি। সকালের মজলিসে স্মরণ করার পর থেকে উপস্থিত হতে থাকি। জোহরের পরের মজলিসগুলোতে হাজির হতে থাকি আর অমূল্য বাণী শুনতে থাকি। সুযোগমতো কিছু আরজও করেছি। স্নেহ—মমতার ধারা অব্যাহত ছিল। সেখানে যাওয়ার পর একটি বিষয়ে ইস্তেখারা করে পরামর্শের কথা বলেছিলেন। নির্দেশ পালন করেছি। মুনাসেব জবাব দিয়েছি। যা সাদরে গৃহীত হয়েছে। ফিরে আসার সময় মনে রাখার মতো মমতায় ধন্য করেছেন।
ব্যস, এই তো দু—সপ্তাহের বিবরণ।
আমি হযরত থানভী রহ.—এর মজলিসে এমনভাবে যাতায়াত করতাম যে, কারও কোনো খবর থাকত না। এখন তো মাশাআল্লাহ হযরতই আশ্রয়স্থল হয়ে যাচ্ছেন। আশা রাখি, দীর্ঘ সময়ের সঙ্গী আমাকে ভুলবে না। আর كُوْنُوْا مَعَ الصّٰدِقِیْنَ এর নির্দেশ মোতাবেক সত্যবাদীদের সঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য হবে।
দুআপ্রার্থী এবং সর্বদাই দুআপ্রার্থী।
—সায়্যিদ সুলাইমান
২৬ মে ১৯৪৮
—মাকতুবাতে সুলাইমান : ২/১২২, ১৮৩
হযরত মাওলানা মুফতী তাকী উসমানী দা. বা. বলেন :
হযরত ডাক্তার (আব্দুল হাই আরেফী) সাহেব রহ. বলেন, আমি একবার দেখলাম হযরত থানভী রহ. কামরায় বসে লেখালিখির কাজে মগ্ন। হযরত সায়্যিদ সাহেব দূরে এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে হযরত থানভী রহ.—এর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন, যেখান থেকে হযরত থানভী রহ.—এর নজর তাঁর দিকে পড়বে না।
আমি হঠাৎই পেছন থেকে তাঁর কাছাকাছি পেঁৗছে গেলাম। বললাম, হযরত, এখানে কী করছেন? কী দেখছেন?
আমার প্রশ্নে হঠাৎ সচকিত হলেন। বললেন, কিছু না।
আমি পীড়াপীড়ি করলে বলেন, আমি এটা দেখছিলাম যে, সারা জীবন যেসব বিষয় ইলম মনে করে এসেছি তার সবই মূর্খতা সাব্যস্ত হলো। ইলম ও জ্ঞানের ভান্ডার তো এ বুযুর্গের কাছে।—ইসলাহী মাজালিস : ৩০০
হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রহ.—এর অনুগ্রহের বর্ণনা
সায়্যিদ সাহেব মাওলানা আব্দুল মাজেদ দরিয়াবাদী রহ.—এর নামে এক চিঠিতে লেখেন :
মুহতারাম (আল্লাহ আপনার সম্মান বৃদ্ধি করুন)
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু
জনাবের মূল্যবান পত্র ১৯ জুলাই হস্তগত হয়েছে। প্রকৃত অর্থে এ মহান পত্রিকার নির্বাচিত অংশ আমাকে পাঠিয়ে রমযানেই পুরো ঈদ এনে দিয়েছেন। এ সবই হযরতওয়ালা রহ.—এর মমতা। যে মমতা তিনি তাঁর সঙ্গে সম্পৃক্ত সকলের মাঝে এভাবেই বিলাতেন। প্রথম দিকের সাক্ষাৎগুলোর অনুভূতি স্মরণ করে আমার এ কবিতার মর্ম আরও গভীর হলো :
دل میں کیا کیا آرزوئے دیدہے
رمضان میں انتظار عید ہے
হৃদয়ে কত শত আকাক্সক্ষার উড়াউড়ি
রমযানেই ঈদের প্রতীক্ষায় অধীর।
মজলিসে কখনো কখনো হযরতের আড় চোখের দৃষ্টি পড়ত আমার ওপর। সে কথা মনে করে আমি কখনো বলে উঠতাম,
اس کی دزد یدہ نگاہی کے نثار آج ہی آغاز کا انجام ہے
دیکھ کر سب نے اسی کو چن لیا جو نگاہ ناز کے قابل ہوا
তার দয়ার দৃষ্টির প্রতি কোরবান হই
যা শুরুতেই পূর্ণতায় পেঁৗছে দেয়।
যার প্রতি চোখ পড়েছে তাকে বেছে নিলেন
সেই পরম প্রার্থিত দৃষ্টিতে।
হযরতওয়ালার আচরণ এমন ছিল যে, প্রত্যেকেই মনে করত তার প্রতি হযরতের বিশেষ মমতা রয়েছে। এ আচরণ মাথায় রেখে কখনো এ কবিতা আবৃত্তি করেছি :
ترا انداز محبت خوب ہے
ہر کسے سے اک نیا اسلوب ہے
আপনার মহব্বতের আন্দাজ বড় অনন্য
প্রত্যেকের সঙ্গে নতুন নতুন ধরন।
—মাকতুবাতে সুলাইমান : ২০৯
হযরত সায়্যিদ সাহেব লিখেছেন,
একবার আমি থানাভবনের মুকীম শ্রদ্ধেয় ভাই মৌলভী মাসউদ আলী সাহেবকে থানাভবনে আমার আসার কথা জানালাম। সঙ্গে রিয়ায মরহুমের একটি পঙ্ক্তি লিখেছিলাম :
زندگی ہے تو فقیروں کا بھی پھیرا ہوگا
বেঁচে থাকলে ফকীরেরও ভাগ্যের মোড় ঘুরবে।
তিনি বিষয়টি হযরতকে জানালেন এবং পঙ্ক্তিটিও শুনালেন। হযরত সঙ্গে সঙ্গে فقیروں পরিবর্তন করে আবৃত্তি করলেন :
زندگی ہے تو سلیمان کابھی پھیرا ہوگا
বেঁচে থাকলে সুলাইমানেরও ভাগ্যের মোড় ঘুরবে।
একবার হযরত রহ. এ অধমকে একটি তাসবীহ হাদিয়া দিলেন। অধম হাদিয়া পেয়ে একটি পঙ্ক্তি আবৃত্তি করি,
خواجہ بخشيد مراسجۂ صد دانہ بلطف
دانہ انداخت ودر حلقہ مرا کرد اسیر
খাজা সদয় হয়ে আমায় শ দানার তাসবীহ দিলেন
দানা ফেলে আমাকে জালে বন্দি করে ফেললেন।
মরহুম ওয়াসল সাহেব এক সুযোগে হযরতকে পঙ্ক্তিটি শোনালেন। হযরত বললেন, ‘ভাই, আমাকে এর জবাব দিতে হবে।’ কিন্তু পরে আর কিছু বলেননি।—হাকীমুল উম্মতকে আছারে ইলমিয়্যাহ, মাআরিফ : ১৯৪৪ ঈ.
হাকীমুল উম্মত থানভী রহ.—এর কাছে নসীহতের নিবেদন
হযরতওয়ালার মন—মনন পূর্ণ শক্তিতে মহান শায়খের ফয়েজ গ্রহণের প্রতি ধাবিত হলো। আগ্রহ—উদ্দীপনা বারবার থানাভবন হাজির হতে বাধ্য করছিল। হযরতের বিশেষ অনুগ্রহে বছরের পথ মিনিটে পাড়ি দিচ্ছিলেন।
ডাক্তার (আব্দুল হাই আরেফী) সাহেব বলেন,
একবার হযরত সায়্যিদ সাহেব থানাভবন আগমন করলেন। বিশেষ মজলিস চলছিল। সায়্যিদ সাহেব হযরত থানভী রহ.—এর একেবারে পাশেই বসা ছিলেন। সায়্যিদ সাহেব চুপে চুপে হযরত থানভী রহ.—এর কানে কানে কিছু বললেন। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর হযরত শায়খ রহ. সায়্যিদ সাহেবের কানে কানে কিছু বললেন। আমরা কেউই তাঁদের কথাবার্তা শুনতে পাইনি। কিন্তু দেখলাম, হঠাৎই সায়্যিদ সাহেব কান্নায় ভেঙে পড়লেন। এমনকি কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেল। এরপর সায়্যিদ সাহেব বিদায় হয়ে গেলেন।
মজলিসের সবাই অবাক হয়ে রইল যে, এ আবার কী হলো! কিন্তু আশরাফী দরবারে এর ব্যাখ্যা জানতে চাওয়ার সাহস কার! বেশ কিছুদিন পর খাজা সাহেব (খাজা আযীযুল হাসান গৌরী মাজযুব) সাহস করে বিষয়টি জিজ্ঞেস করলেন। হযরত হাকীমুল উম্মত রহ. বললেন, নদওয়ার বিশিষ্ট আলেম ঘটনাক্রমে কয়েক ঘণ্টার জন্য উপস্থিত হলেন। বিদায়ের সময় নিবেদন করলেন, আমাকে কিছু নসীহত করুন।
হযরতওয়ালা বলেন, আমি সংশয়ে পড়ে গেলাম, এমন বিশিষ্ট শায়খকে আমি কী নসীহত করব। সঙ্গে সঙ্গেই আল্লাহ তাআলা আমার অন্তরে একটি বিষয় জাগ্রত করে দিলেন। পরে বুঝে এলো তা অবস্থার পূর্ণ উপযোগী ছিল।
আমি বললাম, হযরত, আপনার মতো বিশিষ্ট আলেমকে আমি কী নসীহত করব। তবে হঁ্যা, আমি আমার জীবনে সকল তরীকার সারনির্যাস যা বুঝতে পেরেছি তা—ই আরজ করছি। যে সারনির্যাস আমি বুঝেছি তা হলো, ফানা ও আবদিয়্যত। অতএব যতটা সম্ভব নিজেকে মিটিয়ে দিতে হবে। সকল রিয়াজত ও মুজাহাদা এর জন্যই করা হয়। সারা জীবন ফানা ও আবদিয়্যত অর্জনের পেছনেই ব্যয় করা উচিত।
এ কথাটি তাঁর ওপর এতটা প্রভাব ফেলেছিল যে তিনি কেঁদে ফেললেন।—তাযকিরায়ে সুলাইমান : ১৩৬, আশরাফুস সাওয়ানেহ : ২/২১৮
মুফতী তাকী উসমানী সাহেব বর্ণনা করেন,
হযরত সায়্যিদ সুলাইমান নদভী রহ. হাকীমুল উম্মত থানভী রহ.—এর দরবারে গমন করলেন। যে সায়্যিদ সাহেবের ইলম ও জ্ঞানের ডঙ্কা বাজছিল সমগ্র হিন্দুস্থানে। সীরাতুন্নবীর লেখক, সময়ের সেরা গবেষক। রাজনীতির ময়দানেও প্রসিদ্ধ ও সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। হযরত সায়্যিদ সাহেব নিজেই বলেন, আমি হযরত থানভী রহ.—এর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় আরজ করলাম, হযরত কিছু নসীহত করুন।
হযরত থানভী রহ. বলেন, আমি আল্লাহর কাছে দুআ করলাম, হে আল্লাহ! এত বড় আলেম আমাকে বলছে, নসীহত করুন! হে আল্লাহ! এমন নসীহত আমার অন্তরে ঢেলে দিন যা তাঁর জন্য উপকারী হয়। তো ওই সময় আপনাআপনি আমার মনে এলো, আমাদের এখানে শুরু থেকে শেষ বিষয় তো একটিই। আর তা হলো নিজেকে নিজে বিলীন করে দেওয়া।
হযরত সায়্যিদ সাহেব বলেন, এ কথা বলার সময় হযরত থানভী রহ. হাত ঝাড়া দিলেন। সে ঝাড়া আমার অন্তরে এমনভাবে আঘাত করল যে আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম।—ইসলাহী মাজালিস : ২৯৯
হযরত ডা. আব্দুল হাই সাহেব রহ. বলেন, এ ঘটনার পর হযরত সায়্যিদ সাহেব নিজেকে এমনভাবে মিটিয়ে দিয়েছিলেন যে, এর দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। একদিন দেখলাম, হযরত সুলাইমান নদভী রহ. মজলিসে আগত লোকজনের জুতা সোজা করছেন। এ বিনয় ও বিলীনতা আল্লাহ তাআলা তাঁর মাঝে সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। ফলাফল এই দাঁড়ালো যে, এরপর সুগন্ধি ছড়ালো। আল্লাহ তাআলা তাঁকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গেলেন।—ইসলাহী খুতুবাত : ৫/৩৬
হযরত থানভী রহ.—এর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের পর সায়্যিদ সাহেবের জীবনে অভাবনীয় পরিবর্তন
জনাব সায়্যিদ সবাহুদ্দীন আব্দুর রহমান সাহেব লেখেন, এ সম্পর্কের সঙ্গে সঙ্গে সায়্যিদ সাহেবের দিন—রাত পরিবর্তন হয়ে গেল। যদিও তাঁর পুরো জীবনই দ্বীনদারি ও পরহেজগারীতেই কেটেছে তবুও তরীকতের সুধা পান করার পর তাঁর দ্বীনদারিতে তাকওয়া ও খোদাভীতির গভীর ছাপ পরিলক্ষিত হয়। ইবাদত ও রিয়াজত বেড়ে যায়। যিকরে খফীর (নিঃশব্দ যিকির) পাশাপাশি যিকরে জলীও (সশব্দে যিকির) শুরু করেন। বয়ান—বক্তৃতা রূপ নেয় ওয়াজ ও নসীহতে। বেশিরভাগ সময় ইলমী আলোচনা—পর্যালোচনার পরিবর্তে রুশদ ও হেদায়াতে কাটতে থাকে।—মাআরিফ, সুলাইমান সংখ্যা : ৩৪
মুফাক্কিরে ইসলাম সায়্যিদ আবুল হাসান নদভী রহ. ওই সময়ে সায়্যিদ সুলাইমান নদভীর নদওয়াতুল উলামার আগমনের বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখেন,
মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস রহ. শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রহ. এবং একটি তাবলীগী জামাতও ওই সময় নদওয়ায় অবস্থান করছিল। উভয়ই মেহমানখানায় অবস্থান করছিলেন। এ সময় সায়্যিদ সাহেবের উচ্চৈঃস্বরে যিকির করার বেশ আগ্রহ ছিল। উভয়েই মেহমানখানায় থাকতেন। সায়্যিদ সাহেবের এ অভিরুচি দেখে মাওলানা ইলিয়াস রহ. খুবই আনন্দিত হন।—পুরানে চেরাগ : ৩৮; মাআরিফ, সুলাইমান সংখ্যা : ৩৪, ১১১
মাআরিফ সম্পাদক মাওলানা শাহ মুঈনুদ্দীন নদভী হযরত সায়্যিদ সাহেবের আলোচনা করতে গিয়ে লেখেন, তিনি صِبْغَۃَ الله তথা আল্লাহর রঙে পুরোপুরি রঙিন হয়ে গিয়েছিলেন।
وَمَنْ اَحْسَنُ مِنَ اللهِ صِبْغَۃً
তাঁর মাঝে অভাবনীয় আধ্যাত্মিক বিপ্লব সাধিত হয়েছিল। তাঁর চিন্তাধারায়ও বেশ পরিবর্তন আসে। তাঁর বয়ান—বক্তৃতা ও লেখার ধাঁচও বদলে গিয়েছিল।
হযরতওয়ালা রহ. এর জামাতা জনাব সায়্যিদ হুসাইন সাহেব—যিনি নিজেও হযরত থানভী রহ.—এর বাইআত ছিলেন—হযরত সায়্যিদ সাহেবের এ পরিবর্তনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি লেখেন,
আগে দারুল মুসান্নিফীনের কাজের পর অবসর সময় পরিবার—পরিজনের সঙ্গে দ্বীনি মুযাকারায় কাটাতেন কিংবা শিশুদের সঙ্গে খোশগল্প করতেন। এখন অধিকাংশ সময় নির্জনে কাটান মসজিদে কিংবা নিজের থাকার কামরায়।[6]
আগে আসরের পর দারুল মুসান্নিফীনের সঙ্গীদের সাথে চা পান করতেন। মাগরিব পর্যন্ত তাঁদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করতেন। এ মজলিসের ধারাও বন্ধ হয়ে গেল। কখনো ভক্তরা সায়্যিদ সাহেবের আহলিয়ার কাছে আগ্রহ প্রকাশ করতেন, ‘হযরতের কিছু কথা শোনার ব্যবস্থা করে দিন। বহুদিন হলো তাঁর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পাই না।’ তখন তিনি নির্জনতা ভাঙতেন এবং কিছু সময়ের জন্য বেরিয়ে আসতেন।
পরিবার—পরিজন ও বন্ধুদের নিবেদন তিনি কমই ফিরিয়ে দিতেন। তাই তাদের মনঃতুষ্টির জন্য বৈঠকখানায় বা উঠানে বেরিয়ে আসতেন। কিন্তু মন তাঁর অন্য কোথাও পড়ে থাকত। সকলের খবরাখবর নিতেন এবং দ্রুতই কোথাও উঠে চলে যেতে চাইতেন। কেউ পীড়াপীড়ি করলে কিছুক্ষণের জন্য বসতেন; কিন্তু সকলেই উপলব্ধি করত,
چسکا لگا ہے جام کا شغل ہے صبح و شام کا
اب میں تمہارے کام کاہم نفسو نہیں رہا (محذوب)
পেয়ালার স্বাদ লেগে গিয়েছে এই পোড়ামুখে, তাই সকাল—সন্ধ্যা পেয়ালায় চুমুক দিয়ে ভাব সমুদ্রে ডুবে থাকি / এখন আমি আর তোমাদের কোনো কাজের রইনি হে সহচরগণ।
এ অবস্থা দেখে সকলে পীড়াপীড়ি করা ছেড়ে দিল। হযরতের পরিবার—পরিজনের সঙ্গে দেখা—সাক্ষাৎও কেবল পাঁচ—দশ মিনিটে এসে ঠেকল। বাইরের সফর ছেড়ে দিয়েছিলেন। এম.এ ও অন্যান্য পরীক্ষার পরীক্ষক হওয়া ইত্যাদি পরিত্যাগ করলেন। আর দারুল মুসান্নিফীনের কাজের পর নির্জনতাই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন।
খাওয়া—দাওয়া ও পোশাক—পরিচ্ছদেও বড় ধরনের পরিবর্তন এলো। আগের সব আড়ম্বর জামা—কাপড় বাক্সবন্দি হয়ে রইল। নাদের শাহের দেওয়া শাহি পোশাক পোকা—মাকড়ের খাবারে পরিণত হলো। অধিকাংশ সময়ই বেগম সাহেবা একদিন পরপর কাপড় বের করে দিতেন। কখনো কাজের ব্যস্ততায় খেয়াল না করলে সাধারণ নিয়মের খেলাফ তিন—তিনদিন একই কাপড়ে কাটিয়ে দিতেন।
হযরতের মেজাজ বুঝে কথা বলতে পারে এমন কেউ কেউ কখনো বলে ফেলত, হযরত তাসাওউফের অর্থ তো এটা নয় যে, মানুষের কাপড় পরিবর্তনেরও কোনো খবর থাকবে না।
হযরত মুচকি হেসে বলতেন, বুড়ো হয়ে গেছি। মনে থাকে না। আপনি স্মরণ করিয়ে দেবেন।
এ সময়ে দেখেছি, নিচে ফ্লোরে বসে আছেন। লোকজন এসেছে তো এভাবেই কথাবার্তা বলছেন। কখনো দারুল মুসান্নিফীনের মসজিদের দক্ষিণ দিকের বেষ্টনীর এক কোণায় আল্লাহর যিকিরে মগ্ন হতেন। কখনো ঘরের বৈঠকখানার তখতায় কিংবা অন্য কোনো জায়গায় জায়নামায ছাড়াই আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন দেখা যেত। খাবারের সময় হলে বা অন্য কোনো প্রয়োজনে ঘরের লোকজন তার কাছে গেলে এ অবস্থায় দেখে বলত, এভাবে কেন বসে থাকেন? বললে তো কোনো বিছানা বা জায়নামায বিছিয়ে দেওয়া যেত। এখন শীতের সময়, আবার না ঠান্ডা লেগে যায়।
বলতেন, এসব বাহ্যিক বিষয়ে কী আছে?[7]
এটা ওই ব্যক্তির অবস্থা, উন্নত রুচিবোধে যিনি এ যুগের মির্জা মাজহার জানে জানাঁ শহীদ রহ.—এর প্রতিচ্ছবি ছিলেন। বাহ্যিক ও আত্মিক উন্নত বৈশিষ্ট্যগুলোর মূর্তপ্রতীক ছিলেন। যাঁর চলাফেরা ও পোশাক—পরিচ্ছদ ছিল সম্পূর্ণ রাজকীয়।—তাযকিরায়ে সুলাইমান : ১৩৪; মাআরিফ, সুলাইমান সংখ্যা : ৩২৯, ৩৩২
[1]. কতটা মিথ্যাচার করেছেন ওই সকল লোক যারা মহব্বতের আতিশয্যে এ কথা প্রচার করেছেন যে, হযরত সায়্যিদ সাহেব তো গিয়েছিলেন সাক্ষাতের জন্য। কিন্তু হযরত মাওলানা থানভী রহ. নিজ তাসাররুফের ক্ষমতাবলে তাঁকে বশীভূত করেন। এরপর নিজ থেকেই তাঁকে মুরীদ করে নেন। এ কথায় যদি হযরত থানভী রহ.—এর প্রতি অভিযোগ উত্থাপন করা হয়ে থাকে তাহলে সায়্যিদ সাহেবের সুউচ্চ মর্যাদার কোন দিকের প্রতি লক্ষ রাখা হয়েছে শুনি!—তাযকিরায়ে সুলাইমান—এর টীকা : ১০৯
[2]. দেখুন, হাকীমুল উম্মত : ৪৩৮; তাযকিরায়ে সুলাইমান : ১০৯
[3]. হাকীমুল উম্মত থানভী রহ.—এর এ ধরনের শর্তারোপ সব সময়ের নিয়ম ছিল না। অনেককে তিনি কোনো শর্ত ছাড়াই সঙ্গে সঙ্গে বাইআত করে নিতেন। আবার অনেককে তিনি সঙ্গে সঙ্গে বাইআত করতেন না। বরং বিভিন্ন ধরনের শর্ত জুড়ে দিতেন। উদ্দেশ্য, নিখাদ আগ্রহের পরীক্ষা করা। কখনো শর্তারোপ করতেন, পূর্ণ মুনাসাবাত ও মিল হওয়ার জন্য। কখনো অন্য কোনো কল্যাণ বিবেচনায় এমন করতেন। মূল লক্ষ্য ছিল এই বাইআতের সম্পর্ক যেন রসমী ও প্রথাগত না হয়ে হাকীকী ও সত্যনিষ্ঠ হয়।—সংকলক
[4]. এখানে ওই সময়ের রচিত কয়েকটি পঙক্তি উল্লেখ করা হলো মাত্র।
[5]. ইমাম গাযালী রহ.—এরও ঠিক একই অবস্থার কথা আল্লামা শিবলী রহ. আল গাযালী—তে লিখেছেন। ইমাম গাযালী রহ.—এর উদ্ধৃতিতে তিনি লিখেছেন, অবশেষে আমি সফরের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিগণ তা জানতে পেরে আমাকে পীড়াপীড়ি করে না যাওয়ার জন্য। দুঃখভরে বলে, এটা ইসলামের দুর্ভাগ্য। মানুষকে উপকৃত করার এমন মহৎ কাজ পরিত্যাগ করা শরঈ দৃষ্টিকোণ থেকে জায়েয হয় কীভাবে? ওলামায়ে কেরাম ও জ্ঞানী—গুণী ব্যক্তিবর্গ এ কথাই বলেছিলেন। কিন্তু আমি মূল বিষয়টি উপলব্ধি করছিলাম। অবশেষে সবকিছু ছেড়ে উঠে পড়লাম ও শামের উদ্দেশে রওনা হলাম।—আলমুনক্বিয মিনাদদলাল, ইমাম গাযালী : ২২
[6]. আল্লামা শিবলী রহ. আলগাযালী গ্রন্থে লিখেছেন, ইমাম গাযালী রহ. নিজে আলমুনক্বিয মিনাদদলাল গ্রন্থে লিখেছেন, হজের পর পরিবার—পরিজনের টান দেশে নিয়ে এলো অথচ আমি দেশ থেকে শত মাইল দূরে পালিয়ে বেড়াতাম। দেশে গিয়ে আমি নির্জনতা অবলম্বন করি। সময়ের প্রয়োজন ও জীবিকার সন্ধান আমার স্বচ্ছ সময়কে ধুলোমলিন করে ফেলত। হৃদয়ের নিবিষ্টতা ও প্রশান্তি মিলত কালেভদ্রে।—আলগাযালী : ২৭
[7]. . সায়্যিদ সাহেবের এ অবস্থাও ইমাম গাযালী রহ. এর অবস্থার সঙ্গে মিলে যায়। আল্লামা শিবলী রহ. ইমাম গাযালী রহ. এর আলোচনা করতে গিয়ে লিখেন, ইমাম সাহেব যখন বাগদাদ থেকে বেরিয়েছেন তখন আশ্চর্য রকমের অভিরুচি ও নিজের ব্যাপারে পূর্ণ বেখবর অবস্থায় ছিলেন। আড়ম্বরপূর্ণ দামি পোশাকের পরিবর্তে গায়ে ছিল সাধারণ কম্বল। সুস্বাদু খাবারের পরিবর্তে শাক-পাতায় দিন গুজরান করতেন। এভাবেই বাগদাদ থেকে বের হলেন শামের উদ্দেশে। দামেশক পৌঁছে রিযাজত-মুজাহাদায় মগ্ন হলেন। দৈনিকের রুটিন ছিল, উমাইয়া মসজিদের পূর্ব দিকের মিনারায় উঠে দরজা বন্ধ করে দিতেন। সারা দিন যিকির ও মুরাকাবায় কাটিয়ে দিতেন। বরাবর দু বছর দামেশক ছিলেন। অধিকাংশ সময় মুজাহাদা ও মুরাকাবায় কাটালেও ইলমী কার্যক্রম একেবারে ছেড়ে দেননি। দামেশক থেকে বের হয়ে বাইতুল মুকাদ্দাস পৌঁছেন। এখানের রুটিনও এই ছিল যে, সখরার কামরায় প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিতেন। আর মুজাহাদায় মগ্ন থাকতেন।-আল গাযালী : ২৩-২৫