হাকীমুল উম্মতের দরবারে সায়্যিদ সুলাইমান নদভী
মাওলানা যায়েদ মাজাহেরী নদভী
(পূর্বপ্রকাশের পর)
নিজের রচনাবলি পুনর্নিরীক্ষণের উপলব্ধি ও চিন্তা এবং
আহলে ইলম বন্ধুগণের সঙ্গে পরামর্শ ও নিবেদন
হযরত সায়্যিদ সাহেব হাকীমুল উম্মত থানভী রহ.—এর রচনাবলির পরিচিতি বর্ণনা করতে গিয়ে তারজীহুর রাজেহ গ্রন্থের পরিচিতি পর্বে লেখেন :
তারজীহুর রাজেহ এমন এক সংকলন, যার নজির পূর্ববতীর্ বুযুর্গগণের জীবনে পাওয়া যায় ঠিকই, তবে পরে এসে এ ধারা একেবারেই রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। এ সংকলনে হযরত হাকীমুল উম্মত রহ. ওই সকল মাসায়েল একত্র করেছেন যাতে নিজ থেকেই কিংবা কারও দৃষ্টি আকর্ষণের ফলে শিথিলতা প্রকাশ পেয়েছে। তো তিনি সে শিথিলতা থেকে রুজু করে মাসআলাকে পুনরায় বাড়তি তাহক্বীক করে সংশোধন করেছেন। এ সংকলন হযরতের ন্যায়—নিষ্ঠা, বিনয় ও নিঃস্বার্থ খেদমতের সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। এটা সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীনের পথ ছিল। যা এ যুগে হাকীমুল উম্মত রহ. পুনরায় জীবিত করেছেন এবং নিজেকে আখেরাতের দায় থেকে মুক্ত করেছেন।—মাআরিফ, ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৪ ঈ.
হযরত মাওলানা মুফতী শফী রহ. বলেন :
হযরত আল্লামা সায়্যিদ সুলাইমান নদভী রহ. মুর্শিদ থানভী রহ.—এর শরণাপন্ন হয়েছেন এবং আত্মশুদ্ধির লক্ষ্যে বারবার থানাভবন গিয়েছেন। বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির পাশাপাশি অতীতের কর্মকাণ্ডের প্রতি দৃষ্টিপাত করা এবং ত্রুটি—বিচ্যুতির সংশোধন করাও আত্মশুদ্ধির অনিবার্য অংশ। আল্লাহ তাআলা যখন হযরত সায়্যিদ সাহেবকে নিজেকে বিলীন করার সুউচ্চ স্তরে পেঁৗছে দিলেন তখন অতীত জীবনের কর্মকাণ্ডের নিরীক্ষণ করা ও পেছনের ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি তাঁর বিগত চল্লিশ বছরের ইলমী গবেষণা, রচনা ও প্রবন্ধ—নিবন্ধও পুনর্নিরীক্ষণ করা স্বতন্ত্র ব্যস্ততায় পরিণত হয়। অবশেষে মুহাররম ১৩৬৩ হিজরীতে মাআরিফ, আজমগড় জানুয়ারি ১৯৪৩ ঈ. সংখ্যায় সালাফে সালেহীনের এ পথ ও কর্মপন্থাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। ‘রুজু ও এতেরাফ’ শিরোনামে নিজের সকল রচনার ব্যাপারে একটি মৌলিক নিবন্ধ আর প্রতিটি বিষয়ের ওপর বিস্তারিত নিবন্ধ প্রকাশ করেন। এ ‘রুজু ও এতেরাফ’হযরত সায়্যিদ সাহেবের ইলম ও তাকওয়ার পূর্ণতার প্রমাণ। এ ব্যাপারে স্বয়ং হযরত থানভী রহ. অত্যন্ত আনন্দ প্রকাশ করেন।—তাসভীর কে শরঈ আহকাম : ৭, ৮
হযরত মাওলানা আব্দুল বারী নদভী রহ. মাওলানা সায়্যিদ সুলাইমান নদভী রহ.—এর আলোচনা করতে গিয়ে লেখেন, সায়্যিদ সাহেব স্বভাবতই নিজের মর্জিমতো চলার মানসিকতা থেকে বহু দূরে অবস্থান করতেন।… অন্তরাত্মার পরিশুদ্ধি ও উন্নতি সাধনের অমূল্য যে বৈশিষ্ট্যটি স্বভাবজাতভাবেই সায়্যিদ সাহেবের মাঝে ছিল তা হলো, বড়দের কথা কী বলব, ছোটদের মতকেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করতে তার হৃদয়ে যে উদারতা দেখেছি ঠিক ততটাই সংকীর্ণতা দেখেছি অন্যদের হৃদয়ে।
সায়্যিদ সাহেব হযরত থানভী রহ.—এরই ইশারায় নিজের রচনাবলির হাজারো পৃষ্ঠার পুনর্নিরীক্ষণে ডুবে গেলেন। ১১ রমযান ১৩৬৩ হিজরীর এক চিঠিতে সায়্যিদ সাহেব লেখেন, ‘এদিকে যখন থেকে হযরতওয়ালার ইশারা হয়েছে, যে ব্যাপারে রচিত কবিতা মাআরিফে ছেপেছে; তখন থেকেই এ চিন্তা চেপে বসেছে যে, নিজের সকল রচনা পুনর্নিরীক্ষণ করে রেখে যাব। এরপর যখন ছাপার ছাপবে। আর সীরাত প্রথম খণ্ডের অর্ধেক দেখা হয়ে গেছে। তা এখন ছাপছেও।
এ ধারাবাহিকতায় সীরাতের তৃতীয় খণ্ডও আছে, যাতে মুজিযার বিবরণ রয়েছে। সেখানে আপনার অংশ আপনাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। সরাসরিও আপনাকে বলেছি, আপনি দয়া করে পুনর্নিরীক্ষণ করে পাঠিয়ে দিন। ‘সম্ভবত’, ‘আশা করা যায়’ ধরনের কথা কিংবা উদ্ধৃতি ভুলে যাওয়ার মতো কিছু যেন না ঘটে। এতে আপনার উপকার, উম্মতেরও উপকার।’
সীরাতের ৫ম খণ্ড বের হওয়ার পর বিশেষভাবে লিখেছেন, ‘আপনি কি সীরাতের ৫ম খণ্ড পড়েছেন? আপনাদের এ জন্য জিজ্ঞেস করছি না যে আপনারা প্রশংসা করবেন। বরং এ জন্য বলছি, যেন আমি নিশ্চিন্ত হতে পারি যে ভুল কিছু প্রচারিত হচ্ছে না। আশ্রয় চাই, প্রশংসা নয়।’—মাআরিফ, সুলাইমান সংখ্যা থেকে সংগৃহীত, মে ১৯৫৫। নিবন্ধটি লিখেছেন, মাওলানা আব্দুল বারী নদভী : ৯৮, ১০২
রুজু ও এতেরাফ : ভুল স্বীকার ও সংশোধন
ডা. গোলাম মুহাম্মদ সাহেব তাযকিরায়ে সুলাইমানে লেখেন :
সুলুকের পথে এসে সত্যনিষ্ঠ সালেকের সংশোধনী দৃষ্টি পড়ে নিজের ও নিজের আমলের ওপর। সে কেবল তার বর্তমানেরই নয়; অতীতেরও নিরীক্ষা করে। যেন যেখানেই কোনো ত্রুটি—বিচ্যুতি নজরে পড়ে তার সংশোধন করতে পারে। অতীতের আঁচলে কোথাও কোনো দাগ পড়ে থাকলে তা ধুয়ে ফেলতে প্রয়াসী হয়। এ যুগের শ্রেষ্ঠ সালেকের এ সকল স্তর অতিক্রম করতে হয়েছে। অতীতের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চিন্তা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। অপর দিকে শায়খের প্রতি প্রচণ্ড মহব্বতের কারণে শায়খের কর্মপদ্ধতি তার এতটাই প্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, এর জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা আপনাতেই তার মনে সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। ফলে হাকীমুল উম্মতের কোনোরূপ ইশারা—ইঙ্গিত ব্যতীতই নিজের অনুভূতি থেকেই ‘রুজু ও এতেরাফ’ শিরোনামে মাআরিফ, জানুয়ারি ১৯৪৩ ঈ. সংখ্যায় একটি নিবন্ধ ছেপে দেন। যা তার সে অবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে, যে অবস্থা হওয়ার কারণে খসরু নিঃসংকোচে বলে উঠেছেন :
خلق میگو ید کہ خسرو عشق بازی می کند
آرے آرے میکنم باخلق عالم کا رنیست
মানুষ বলাবলি করে, খসরু ইশকবাজি করে
আরে ইশকবাজিই তো করি, মানুষের কথায় কী আসে যায়।
মাওলানার সে হৃদয় নিংড়ানো লেখা নিম্নে প্রদত্ত হলো। দিল ও দেমাগের গভীর অভিনিবেশসহ পড়–ন, যেন সে মহান অবস্থার ধারা আপনার প্রতিও প্রবাহিত হয়।—তাযকিরায়ে সুলাইমান : ১৪৫
আল্লামা সায়্যিদ সুলাইমান নদভীর নিজস্ব কিছু গবেষণার সংশোধন
হযরত আল্লামা সায়্যিদ সুলাইমান নদভী রহ. লেখেন,
আমার জন্ম ১৩০২ হিজরীর সফর মাসে। এখন ১৩৬২ হিজরীর মুহাররম মাস শুরু হলো। অর্থাৎ আমার বয়স জীবনের ষাটটি মনযিল অতিক্রম করেছে। আমার লেখালিখির শুরু ১৯০২ ঈ.। এখন ১৯৪২ চলছে। তার মানে আমার লেখালিখির বয়সও ৪০ বছর পূর্ণ হয়েছে। যখন এদিকে লক্ষ করি, আমার এ ষাট বছরের জীবনে কী কী ভুল করেছি আর কী কী বিচ্যুতি ঘটেছে, তখন মন আপনিতেই বলে ওঠে :
از كردۂ نا صواب يا رب توبہ
হে রব, সকল বিচ্যুতি থেকে তওবা।
আমার লেখক জীবন ৪০ বছর হয়ে গেছে। মনে নেই এ দীর্ঘ চল্লিশ বছরে কলম কী কী লিখেছে, আর কোথায় কোথায় ভুল করেছে। হকের অনুসরণের পরিবর্তে কোথায় মনের কামনা—বাসনার অনুগামী হয়েছে। এখনো নিজের বর্তমান করুণ অবস্থা দেখে আমার অবস্থার ভাষায় অদৃশ্য আওয়াজ ভেসে আসে :
چہل سال عمر عزیزت گذشت
مزاج تو از حال طفلی نہ گشت
জীবনের মহামূল্যবান চল্লিশটি বছর পেরিয়ে গেল
তবু স্বভাব—চরিত্র থেকে বালখিল্যতা গেল না।
কিতাব—পত্র ও প্রবন্ধ—নিবন্ধের হাজারো পৃষ্ঠা যে এতদিন কালো করা হয়েছে, বলা তো যায় না কোথায় কোথায় হকের সঙ্গ পরিত্যাগ করা হয়েছে, কোন বাতিলের সমর্থনে এ কলম বিচ্যুতি করেছে, যাতে হকের অনুসরণের পরিবর্তে মনের কামনা—বাসনার অনুগামিতায় লিপ্ত হয়েছে। অধম সর্বদাই ত্রুটিপূর্ণ। ভুল করা ও ভুলে যাওয়াই যার স্বভাব। এ অধমের ইলম ও আমলের বিচ্যুতির স্তূপ থেকে সঠিকভাবে বেঁচে থেকে বেরিয়ে আসা খুবই মুশকিল। তাই এ নগণ্য অধম তার জীবনের সকল ভুল ও বিচ্যুতি থেকে (যা জেনে বা না জেনেই হকের পরিপন্থি হয়েছে) প্রকাশ্যে খাঁটি দিলে তওবা করছে। নিজের ভুলত্রুটি স্বীকার করছে। এবং তার বিপথগামী চিন্তাধারা, যার কোনো ভিত্তি কোরআন ও সুন্নাহতে নেই, তা থেকে দায়মুক্তি ঘোষণা করছে।
و ما توفيقى إلا بالله
—মাআরিফ, শাযারাতে সুলাইমান
জানুয়ারি ১৯৬৩ : ৩১৮
মাযহাবী মাসায়েলের ক্ষেত্রে সায়্যিদ সাহেবের কর্মপন্থা
সায়্যিদ সাহেব বলেন, মাযহাবী মাসায়েলের তাহকীকের ক্ষেত্রে আমার কর্মপদ্ধতি হলো, আক্বায়েদের ক্ষেত্রে সালাফে সালেহীন রাহিমাহুমুল্লাহর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়া। অবশ্য ফিক্বহী বিষয়ে একেবারে পরিপূর্ণরূপে একজন মুজতাহিদের অনুসরণ করা হয়ে উঠেনি। বরং নিজের সাধ্যের সবটুকু দিয়ে দলীলগুলোর পর্যালোচনার পর ফুকাহায়ে কেরামের কোনো একটি মতকে প্রাধান্য দিয়েছি। কিন্তু কখনো এমন কোনো মত গ্রহণ করিনি, যাকে হক্কানী ইমামগণের একজনও সমর্থন করেননি। বিশেষ করে মাসায়েলের ব্যাখ্যা—বিশ্লেষণে ইবনে তাইমিয়া, ইবনে কায়্যিম ও শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ.—এর তাহকীকের ওপর নির্ভর করেছি বেশি।
মেরাজ ও জাহান্নাম নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার মাসআলায় রুজু
এমনও দু—চারবার হয়েছে যে, এক তাহকীকের পর অপর কোনো তাহকীক সামনে এসেছে এবং নিজের ভুল বুঝে এসেছে। তো পরবর্তী সংস্করণে পরিবর্তন করে ফেলেছি। যেমন : জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে মেরাজের পক্ষে কোরআন শরীফ থেকে সহীহ কোনো প্রমাণ মেলেনি। পরে আল্লাহ তাআলা দয়া করে সহীহ দলীল বুঝিয়ে দিয়েছেন। পরবর্তী সংস্করণে এ বিষয়টি যুক্ত করে বিষয়টি সংশোধন করে দিয়েছি।
এমনইভাবে ফানায়ে নার তথা জাহান্নাম নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার মাসআলা হাফেয ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে কায়্যিমের অনুসরণে লিখেছি। পরে জমহুর ওলামায়ে কেরামের অভিমতটি যুক্ত করে উভয় পক্ষের দলীল—প্রমাণের ব্যাখ্যা পেশ করেছি। আর এখন আলহামদুলিল্লাহ এ মাসআলায় জমহুরের অভিমতই যে সঠিক তা বুঝে এসেছে।
و ما توفيقى إلا بالله
ছবির মাসআলায় রুজু
ছবির প্রসঙ্গে ১৯১৯ ঈ. একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। ওই নিবন্ধে প্রাণীর ছবি তোলা, বিশেষত অর্ধেক শরীরের ফটো তোলা জায়েয লিখেছিলাম। এ বিষয়ে পরবর্তী সময়ে হিন্দুস্তান ও মিশরের কয়েকজন আলেমও লিখেছেন। এদের কারও কারও মত ছিল আমার মতোই, আর কেউ কেউ ছিল বিরোধী মতের। যাক, এ বিষয়ের সকল দিক সামনে চলে এলো। তাই এখন সকল দিক সামনে রেখে আমি এ মতের সঙ্গেই একাত্মতা পোষণ করছি যে, প্রথম বিষয় অর্থাৎ ক্যামেরা ইত্যাদির দ্বারা যে ছবি তোলা হয়, তা হাতের ছবির মতোই নাজায়েয। অর্ধেক শরীরের ছবি তোলাও নাজায়েয। তবে নিরুপায় অবস্থায় তোলানো যেতে পারে। আর মস্তক ও চেহারা ব্যতীত কেবল শরীরের ছবি তোলা—তোলানো উভয়ই জায়েয। বিস্তারিত সামনে লেখা হবে, ইনশাআল্লাহ।
অলংকারের যাকাতের মাসআলায় রুজু
অলংকারে যাকাত ফরয হওয়া না হওয়ার মাসআলায় সাহাবায়ে কেরামের মাঝেই ইখতেলাফ ছিল। বিভিন্ন রেওয়ায়েত থেকে বুঝে আসে হযরত আয়েশা রাযি. অলংকারে যাকাত না আসার মত ব্যক্ত করতেন। সীরাতে আয়েশা রাযি. গ্রন্থে তাঁর এ মতের বিশ্লেষণ আমার কলমে এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে তাঁর এ মতের সমর্থন বলে মনে হয়। এক আলেম অত্যন্ত চমৎকারভাবে এক পুস্তিকায় এর জবাব লিখেছেন। পুস্তিকাটি ছেপেছেও। তাই এ ভুল ধারণা দূর করে দেওয়া জরুরি। আমি বলতে চাই, অলংকারের যাকাতের মাসআলায় আমি জমহুর উলামায়ে কেরামের মতানুযায়ী এতে যাকাত ফরয হওয়ার পক্ষে। আলহামদুলিল্লাহ, এর ওপরই আমি আমল করি। বইটির পরবর্তী সংস্করণে এ বিষয়টিও সংশোধন করে দেব।
এ কথাগুলো কোনো আপত্তি উত্থাপনকারীর ভয়ে নয়, কেবল আল্লাহ পাকের দরবারে নিজের দায়িত্ব মনে করে লিখছি। দুআ করি, প্রভু হে, আমাকে সিরাতে মুসতাকীমের ওপর অবিচল রাখুন। যখনই মানবিক দুর্বলতার দরুন কোনো ভুল হয়ে যায়, তখনই আমাকে সতর্ক ও ক্ষমা করুন। মুসলমানদেরকে এর ক্ষতি থেকে রক্ষা করুন। আমাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করুন।
رَبَّنَا اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِیْمَ صِرَاطَ الَّذِیْنَ اَنْعَمْتَ عَلَیْهِمْ ۬ۙ غَیْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَیْهِمْ وَلَا الضَّآ لِّیْنَ. رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَاۤ اِنْ نَّسِیْنَاۤ اَوْ اَخْطَاْنَا…… وَاعْفُ عَنَّا وَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا اَنْتَ مَوْلٰنَا !
মুসলমানদের মধ্যে যদি কেউ এমন থাকেন যিনি আমার কারণে এ সকল মাসআলায় আমার মত গ্রহণ করেছেন, তাহলে তার খেদমতে নিবেদন করছি, তিনি যেন আমার রুজু ও সংশোধনের পর রুজু করে নেন এবং সঠিক বিষয়টি গ্রহণ করেন। পূর্বসূরি উলামায়ে কেরামের মাঝে পূর্বমত থেকে ফিরে আসা, অন্য মতকে প্রাধান্য দেওয়া ও দ্বিতীয় মত ব্যক্ত করার ব্যাপক প্রচলন ছিল। এটা তাদের হকের অনুসরণ।
والحق أحق أن يتبع
(হকই তো অনুসরণযোগ্য)
والسلام على من اتبع الهدى
—মাআরিফ, জানুয়ারি : ১৯৪৩
তাযকিরায়ে সুলাইমান : ১৬০—১৬২
রুজু ও এতেরাফের কারণে হযরত থানভী রহ.—এর সায়্যিদ সাহেবের প্রশংসা
বাযমে আশরাফ কা চেরাগ—এর সংকলক লেখেন :
হযরত সায়্যিদ সাহেব হাকীমুল উম্মতের কোনো ধরনের ইশারা—ইঙ্গিত ছাড়াই নিজ অনুভূতি থেকেই রুজু ও এতেরাফ শিরোনামে মাআরিফ জানুয়ারি ১৯৪৩ সংখ্যায় নিবন্ধ প্রকাশ করেন। মাআরিফের এ সংখ্যাটি হযরত থানভী রহ.—এর খেদমতে পেশ করেন। লেখাটি হযরত থানভী রহ.—এর মনে বিরাট প্রভাব ফেলে। তিনি তাঁর স্বভাব ও রুচির বিপরীতে জীবনে প্রথম ও শেষবারের মতো নিজের প্রিয় খলীফার প্রশংসায় কবিতা লিখে পাঠান :
اعتراف (یعنی اخذ اعلان)
از اعتراف ( یعنی رجوع سلیمان)
সুলাইমান নদভীর ভুল স্বীকার থেকে সংগৃহীত সর্বজন জ্ঞাতব্য বিষয়
لمثل ہذا فلیعمل العاملون
وفي ذلك فليتنافس المتنافسون
এমন দিনের জন্যই আমলকারীদের আমল করা উচিত
এ ক্ষেত্রেই প্রতিযোগীদের প্রতিযোগিতা করা উচিত
اقتباس ترغیب دل پذیر
از مثنوی رومی بتصرف یسیر
হৃদয়ছোঁয়া অনুপ্রেরণার চয়নিকা
রুমীর মসনবী থেকে খানিকটা এদিক—সেদিক করে।
از سلیمان گیر اخلاص عمل
وان تو ندوی را منزه از دغل
আমলে ইখলাসের পাঠ গ্রহণ করুন সুলাইমান থেকে
নদভী সাহেব কপটতা থেকে মুক্ত জানুন
اے دلت معمور از اسرار حق
اے دلت مخمور از آثار حق
তোমার হৃদয় মাওলার মারেফাতের রহস্যে ভরা
হৃদয় তোমার মাওলার মারেফাতের নিশানা দর্শনে বিভোর।
اے دلت پر نور از انوار حق
اے دلت مسرور از اخبار حق
তোমার হৃদয় মাওলা পাকের নূর তাজাল্লীতে আলো ঝলমল
হৃদয় তোমার মাওলা পাকের (মারেফাতের) খবরা—খবরের আনন্দে বিভোর।
اے دلت پر نور از انوار حق
اے دلت مسرور از اخبار حق
এই সত্য প্রকাশের সুবাদে আপনাকে হাজারো মোবারকবাদ
এই সত্য স্বীকারের জন্য আপনার প্রতি হাজারো মোবারকবাদ
لیک باشد ایں طریق نفع خاص
کہ بہ اہل علم دار واختصاص
তবে এ তরিকার বিশেষ উপকার লাভ হয় আহলে ইলম ও বিশিষ্টজনদের
سعی نفع عام اینجا واجب است
آنکہ نافع بہر ہر ہر طالب است
এখানে (এ তরিকায়) আম উপকারের চেষ্টা আবশ্যক,
যাতে প্রত্যেক তালেবের তরে উপকারী হওয়া যায়।
در کلام خود نظر خود کردنی
یا کہ نقادے بدست آوردنی!
নিজের বক্তব্যে নিজেরই নজর রাখা উচিত
নতুবা সমালোচকদের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়।
ہمچناں کردم بہ تالیفات خویش
صرف ہم کردم اے او نقد خویش
নিজের রচনাবলির ক্ষেত্রে আমি নিজেও এই নীতি অনুসরণ করেছি। / নিজের সমালোচনা নিজেই করেছি।
گر چہ ناظم نیستم ابیات را
نثر کردم لیک ایں جذبات را
পদ্যের মালা গাঁথা যদিও আমার কাজ নয়
তবুও পদ্যেই নিজের আবেগ উৎসর্গ করলাম।
مقصد من خیر خواہی ہست دبس
بوکہ با رغبت فتد در گوش کس
উদ্দেশ্য কেবল কল্যাণকামিতা, হয়তো কোনো আগ্রহীর কর্ণগোচর হবে
(আর তাতে তার ভেতরেও আলোড়ন জাগবে।)
—আশরাফ আলী
২৭ মুহাররম ১৩৬১ হিজরী
—বাযমে আশরাফকে চেরাগ : ৮১
শেষ সাক্ষাতে সায়্যিদ সাহেবের আবেগঘন কিছু পঙ্ক্তি
এ বিষয় ও তিন পঙ্ক্তি প্রসঙ্গে সায়্যিদ সাহেব নিজেই লিখেছেন :
যখন তিনি হযরত থানভী রহ.—এর দরবারে শেষবার হাজির হয়েছিলেন তখন হযরতওয়ালা তাকে মহব্বত করে হেলান দেওয়ার একটি বিশেষ চেয়ারে বসার নির্দেশ দিলেন। হযরত কিছুক্ষণ পরপরই তন্দ্রাচ্ছন্ন কিংবা ধ্যানমগ্ন হতেন। ফলে চোখ বন্ধ হয়ে যেত। এ পঙ্ক্তিগুলোর রচয়িতা তখন রুমাল দিয়ে হযরত থেকে মাছি তাড়াচ্ছিল। এ পরিস্থিতিতে তার মন—মস্তিষ্কে এ অনুভূতিগুলো উড়ে বেড়াচ্ছিল :
دل بھر کے دیکھ لو یہ جمال جہاں فروز
پھر یہ جمال نور دکھایا نہ جائے گا
মন ভরে দেখে নাও দুনিয়া আলো করা এই সৌন্দর্য
পুনরায় আর দেখা যাবে না এ দীপ—শিখা
گوش جہاں بغور سنے اس کلام کو
پھر یہ کلام شوق سنایا نہ جائے گا
দুনিয়াবাসী মন দিয়ে শোনো দরদভরা এ কথা
আকুল করা এ কথামালা আর শুনতে পাওয়া যাবে না।
اے میکشو یہ درد تہ جام بھی پیو
ترسو گے پھر یہ جام پلایا نہ جائے گا
সুরা পিয়াসীরা এ পাত্রের শেষ চুমুকটিও শুষে নাও
পরে আফসোস করবে কিন্তু এর দেখা আর পাবে না।
—তাযকিরায়ে সুলাইমান : ১৮০
হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রহ. ইন্তেকালের গভীর প্রভাব
মুর্শিদ থানভী রহ.—এর বিদায়ে হযরত সায়্যিদ সাহেবের হৃদয়ে কতটা গভীর প্রভাব পড়েছিল তার অনুমান করা আমাদের পক্ষে কীভাবে সম্ভব হবে? তবে এতটুকু তো নিজ চোখেই দেখেছি—দুঃখজনক এ ঘটনার ৯/১০ মাস পর অর্থাৎ মার্চ/এপ্রিল ১৯৪৪ ঈ. যখন দক্ষিণ হায়দ্রাবাদ আগমন করলেন তখন চেহারা—সুরতে চিন্তার ছাপ ও চলায়—বলায় এতটাই ব্যথিত ও ভারাক্রান্ত ছিলেন যে, মাহফিলের সবার অন্তর বিগলিত হয়ে যেত। বোঝা যেত হযরতের অন্তর এখনো মারাত্মক আহত অবস্থায় আছে।… প্রিয়তমের বিচ্ছেদের এ ছাপ বছরখানেক ছিল। বরং নিজেকে সামলে নেওয়ার পরও জীবনের শেষ পর্যন্ত দেখেছি, যখনই থানভী রহ.—এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের স্মৃতিচারণ করতেন তখনই কণ্ঠ ভারী হয়ে আসত। চোখ অশ্রম্নসজল হয়ে যেত। এক—আধ বাক্য বলেই চুপ হয়ে যেতেন।
এ বেদনাদায়ক ঘটনার পরপরই ব্যথিত ও ভারাক্রান্ত হৃদয়ে একপ্রকার বাধ্য হয়েই কিছু কবিতা রচনা করেন। কিন্তু যেহেতু নিজে একজন আরেফ ও মসনদে ইরশাদে সমাসীন ছিলেন, তাই আবেগের উচ্ছাস কখনো শরীয়তের সীমারেখা স্পর্শ করেনি এবং কান্না ও আহাজারিতেও সবরের ছাপ ছিল।—তাযকিরায়ে সুলাইমান : ১৮০