হাকীমুল উম্মতের নসীহত : পর্দা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান
পর্দা প্রসঙ্গে হাদীস
১. হযরত আলী রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর সামনে উপস্থিত ছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবাইকে জিজ্ঞাসা করলেন, বলো, নারীর জন্য সবচেয়ে উত্তম বিষয় কী? তখন সাহাবায়ে কেরাম সকলেই চুপ থাকলেন। কেউ উত্তর দিলেন না। হযরত আলী রাযি. বলেন, আমি ঘরে এসে ফাতেমাকে জিজ্ঞাসা করলাম, নারীর জন্য সবচেয়ে উত্তম বিষয় কী?
ফাতেমা বলল, সে কোনো পরপুরুষকে দেখবে না এবং কোনো পরপুরুষও তাকে দেখবে না।
আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ উত্তর শুনালাম। তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ফাতেমা আমার কলিজার টুকরা। (এজন্য সে খুব ভালো বোঝে।)—মুসনাদে বাযযার; দারা কুতনী ফিল ইফরাদ
২. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, নারীদের জন্য ঘরের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই, তবে একান্ত বাধ্য ও অনন্যোপায় হলে ভিন্ন কথা। (অর্থাৎ নারীদের জন্য একান্ত প্রয়োজন ও অপারগতা ছাড়া ঘরের বাইরে না যাওয়া উচিত।)
এই হাদীসে এ কথাও আছে যে, নারীদের জন্য রাস্তায় চলাচলের কোনো অধিকার নেই, তবে কিনারা দিয়ে চলতে পারবে। (অর্থাৎ জরুরত হলে বাইরে যেতে পারবে এবং রাস্তায় চলার প্রয়োজন হলে কিনারা দিয়ে চলবে।)—তবারানী ফিল কুবরা
৩. হযরত জাবের রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, নারী শয়তানের আকৃতিতে সামনে আসে এবং শয়তানের আকৃতিতে ফিরে যায়। (অর্থাৎ শয়তান নারীর মাধ্যমে মানুষকে পথভ্রষ্ট করে এবং কুদৃষ্টির গোনাহে লিপ্ত করে।)—সহীহ মুসলিম
৪. হযরত আবূ মূসা আশআরী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে নারী আতর ও সুগন্ধি ব্যবহার করে পুরুষের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে আর পুরুষ তার সুগন্ধির ঘ্রাণ নেয়, ওই নারী ব্যভিচারীনী এবং তার প্রতি দৃষ্টিপাতকারী চোখ ব্যভিচারী।—সুনানে নাসায়ী, ইবনে খুযায়মা
৫. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, নারীর সমস্ত শরীর ঢেকে রাখার বস্তু। সে বাইরে বের হলে শয়তান তার পিছু নেয়।—সুনানে তিরমিযী, মেশকাত
এ হাদীসে সুস্পষ্ট ভাষায় নারীদের পর্দায় থাকার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এবং বাইরে বের হওয়াকে শয়তানী ফেতনার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
৬. হযরত উম্মে সালামা রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি এবং হযরত মাইমুনা রাযি. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর খেদমতে উপস্থিত ছিলেন। ইতিমধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (অন্ধ সাহাবী) রাযি. আগমন করলেন এবং ভেতরে প্রবেশ করতে উদ্যত হলেন। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা দুজন পর্দার আড়ালে চলে যাও।
আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, তিনি তো অন্ধ, আমাদেরকে দেখবেও না।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উত্তরে বললেন, আচ্ছা, তোমরাও কি অন্ধ? তোমরা কি তাকে দেখছ না?—সুনানে আবূ দাউদ, মেশকাত
দেখুন, এখানে মন্দ ও অনিষ্টের সামান্যতম কোনো সম্ভাবনাও ছিল না। কেননা একদিকে নবীজির পবিত্র স্ত্রীগণ, যারা মুসলিম উম্মাহর মা, অপরদিকে একজন সাহাবী, আবার তিনি অন্ধ। কিন্তু তা সত্ত্বেও সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের জন্য কিংবা উম্মতকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের স্ত্রীদের পর্দার হুকুম দিয়েছেন। সুতরাং যেখানে এ ধরনের খারাপ কিছু ঘটার পথে কোনো প্রতিবন্ধক নেই সেখানে কেন পর্দার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হবে না।—আল কাওলুস সাওয়াব
৭. হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হাতের যিনা হলো গাইরে মাহরামকে স্পর্শ করা। চোখের যিনা হলো গাইরে মাহরামকে দেখা। মুখের যিনা হলো গাইরে মাহরামের সঙ্গে কথা বলা।—সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম
৮. হযরত মা‘কিল ইবনে ইয়াসার রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমাদের কারও মাথায় লোহার সুঁই ফুঁড়ে দেওয়া উত্তম ওই কাজের তুলনায় যে, সে এমন মহিলাকে স্পর্শ করবে যে তার জন্য হালাল নয়।—তবারানী, মুসতাদরাকে হাকেম, বায়হাকী
৯. হযরত উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যখন কোনো ব্যক্তি কোনো মহিলার সঙ্গে নির্জনে থাকে তখন অবশ্যই তাদের তৃতীয় সঙ্গী হয় শয়তান।—সুনানে তিরমিযী
গাইরে মাহরাম নারী—পুরুষের জন্য একত্রে নির্জন স্থানে বসা হারাম। পর্দার বিধান না থাকলে স্বাভাবিক রীতি—নীতি ও বাস্তবতাই প্রমাণ যে, এক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা হবে না।
১০. হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে (নারীর ওপর) হঠাৎ দৃষ্টি পড়ে যাওয়ার হুকুম জিজ্ঞাসা করলাম।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুকুম দিলেন, তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি সরিয়ে নাও।—সহীহ মুসলিম
১১. হযরত উকবা ইবনে আমের রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, নারীদের কাছে আনাগোনা থেকে বেঁচে থাকো। কেউ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, স্বামীর ভাই (অর্থাৎ দেবর) ও এ পর্যায়ের পুরুষদের হুকুম কী?
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, স্বামীর ভাই তো মৃত্যু সমতুল্য। (অর্থাৎ ধ্বংস ও গোনাহের কারণ। এজন্য তার সাথেও পর্দা করা ফরয।)—সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম
এ হাদীসে জরুরত ছাড়া এবং নির্দ্বিধায় নারীদের কাছে আনাগোনা হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে।
১২. ইবনে আবী মুলাইকা থেকে বর্ণিত, তিনি হযরত আয়েশা রাযি. কে বললেন, এক মহিলা পুরুষের জুতা পরিধান করে। আয়েশা রাযি. বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বনকারী নারীদের ওপর (অর্থাৎ পুরুষদের মতো পোশাক ও জুতা পরিধানকারী নারীদের ওপর) লানত করেছেন।—সুনানে আবূ দাউদ
১৩. হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে মহিলা আল্লাহ তাআলা ও কেয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে, তার জন্য তার স্বামীর ঘরে তার অনুমতি ব্যতীত কাউকে আসতে দেওয়া জায়েয নয়।—তবরানী, মুসতাদরাকে হাকেম, বায়হাকী
এমনিভাবে নারীর জন্য তার স্বামীর অনুমতি ছাড়া বাইরে বের হওয়াও জায়েয নয় এবং এ বিষয়ে কারও অনুসরণ করাও জায়েয নয়।
১৪. হযরত উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে মহিলাদের সাথে তাদের স্বামীর অনুমতি ছাড়া কথা বলতে নিষেধ করেছেন।—তবারানী
১৫. হযরত হাসান বসরী রহ. থেকে মুরসাল বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, আমার কাছে এ নির্দেশনা পৌঁছেছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মহিলারা তাদের মাহরাম ছাড়া পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলবে না।—ইবনে সাদ
১৬. হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তিন ব্যক্তি কখনো জান্নাতে প্রবেশ করবে না : এক. দাইয়ুস, দুই. পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বনকারী নারী, ৩. সর্বদা মদ পানকারী।
সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, দাইয়ুস কাকে বলে?
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে ব্যক্তি তার পরিবারভুক্ত নারীদের কাছে কে আসা—যাওয়া করছে তার কোনো পরোয়া করে না।—তবারানী ফিল কুবরা
১৭. হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে গমন করলেন। এ সময় মুযায়না গোত্রের এক মহিলা আকর্ষণীয় পোশাক পরিধান করে (অর্থাৎ খুব সেজেগুজে) অঙ্গভঙ্গি করে মসজিদে আসল। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে লোকসকল, তোমরা তোমাদের নারীদেরকে সাজ—সজ্জার পোশাক পরিধান করে মসজিদ ইত্যাদিতে আকর্ষণীয় অঙ্গ—ভঙ্গি করা থেকে বিরত রাখো। কেননা বনী ইসরাঈলের ওপর ততক্ষণ পর্যন্ত অভিশাপ নাযিল হয়নি, যতক্ষণ না তাদের মহিলারা সাজ—সজ্জার পোশাক পরিধান করে আকর্ষণীয় অঙ্গ—ভঙ্গি অবলম্বন করেছে।—ইবনে মাজাহ
১৮. আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষদেরকে নারীদের মাঝে চলাচল করতে নিষেধ করেছেন।—সুনানে আবূ দাউদ
১৯. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি আমার উম্মতের জন্য নারীদের চেয়ে অধিক ভয়ঙ্কর কোনো ফেতনা দেখি না।—আল ফায়জুল হাসান : ১৬৯
ফুকাহায়ে কেরাম ও বিজ্ঞ আলেমদের মতামত
এ প্রসঙ্গের আয়াত, হাদীস ও আছারের আলোকে যে মূলনীতি সামনে আসে তার সারকথা হলো, ফেতনার দরজা বন্ধ করা। এর ভিত্তিতে ফুকাহায়ে কেরাম যে সকল ফতওয়া প্রদান করেছেন, তা থেকে কয়েকটি ফতওয়া নমুনাস্বরূপ পেশ করা হলো :
১. মহিলাদের জন্য জেহরী নামাযে (মাগরিব, এশা, ফজর) উচ্চৈঃস্বরে কেরাত পড়া জায়েয নয়।
২. মহিলাদের জন্য হজের সময় লাব্বাইক (তালবিয়া) উঁচু আওয়াজে বলা জায়েয নেই।
৩. মহিলা যদি মুকতাদী হয়, উদাহরণত তার স্বামী বা মাহরাম (ভাই, বাবা বা অন্য মাহরাম) কারও পেছনে নামায পড়ে, আর ইমামের কোনো ভুল হয়ে যায়, তাহলে মহিলার জন্য মুখে লুকমা দেওয়া জায়েয নেই। বরং হাতের ওপর হাত মেরে আওয়াজ দিবে, যেন ইমাম বুঝতে পারে যে আমার কোনো ভুল হয়েছে। তখন সে চিন্তা করে তা স্মরণ করে নিবে।
৪. যুবতীদের জন্য গাইরে মাহরাম পুরুষকে সালাম দেওয়া জায়েয নেই।
৫. যখন উচ্চৈঃস্বরে কেরাত পড়া, লাব্বাইক বলা এবং ইমাম সাহেবের ভুল হলে সুবহানাল্লাহ বলা জায়েয নেই, তখন জরুরত ছাড়া কথা বলা, গজল শোনানো, চিঠি—পত্র লেখা, যা কথা—বার্তার চেয়েও বেশি আকর্ষণীয়—এসব কীভাবে জায়েয হবে? বর্তমানে পত্র—পত্রিকায় যেভাবে নাম—ঠিকানাসহ লেখা ছাপানো হচ্ছে, তা কীভাবে জায়েয হবে?
৬. (স্ত্রী ছাড়া) পরনারী দ্বারা শরীর ম্যাসেজ করানো (শারীরিক সেবা নেওয়া) জায়েয নেই।
৭. মহিলাদের হাতে হাত মেলানো—যেমন জাহেল পীরেরা বাইয়াত করার সময় করে থাকে—কীভাবে জায়েয হবে?
৮. পরনারীর পরিহিত কাপড়ের দিকে আকর্ষণ নিয়ে দেখা জায়েয নয়।
৯. আয়না বা পানিতে মহিলার যে প্রতিবিম্ব ভেসে উঠে তা দেখাও জায়েয নয়। এমনিভাবে গায়রে মাহরামের ছবি দেখাও জায়েয নেই।
১০. পরপুরুষের খাবারের অবশিষ্ট অংশ মহিলার জন্য খাওয়া, এমনিভাবে পরনারীর খাবারের অবশিষ্ট অংশ পুরুষের জন্য খাওয়া মাকরুহ, যদি এর প্রতি মনে বিশেষ আকর্ষণ থাকে।
১১. দুধ ভাই, মেয়ের জামাই ও স্বামীর (অন্য স্ত্রীর) ছেলে যদিও মাহরাম (অর্থাৎ তাদের সঙ্গে পর্দা নেই) তবুও যামানার ফেতনার দিকে লক্ষ্য করে তাদের সবার সঙ্গে গায়রে মাহরামের মতো পর্দা করা জরুরি।
১২. মহিলাদের কর্তিত চুল ও নখ দেখাও জায়েয নয়।
১৩. পরনারীর আলোচনার মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি লাভ করা জায়েয নয়।
১৪. পরনারীর কল্পনা করে মানসিক তৃপ্তি অনুভব করা জায়েয নয় ।
১৫. এমনকি নিজের স্ত্রীর সঙ্গে মেলামেশা করা অবস্থায় পরনারীর কল্পনা করাও হারাম।—সুবাতুস সুতুর : ৪১
(মাওলানা যায়েদ মাজাহেরী সংকলিত আহকামে পরদা থেকে অনুবাদ করেছেন, মাওলানা মাহবুবুর রহমান)
কোরআনের প্রতি অবহেলা না করি
কিছুদিন আগে পারিবারিক অনুষ্ঠানে এক আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা। মাশাআল্লাহ, কোরআনের পেছনে সে অনেক মেহনত করেছে। তাঁর তেলাওয়াত অনেক সুন্দর। আরবী প্রতিটি হরফ পূর্ণ সিফাতসহ উচ্চারণ করে। আমি তাঁকে আমার তেলাওয়াত শুনিয়েছিলাম। আল্লাহ তাআলা তাকে জাযায়ে খায়ের দান করুন। তেলাওয়াত শোনানোর পর মনে হলো, কোরআনের পেছনে আমাদের আরও সময় দেওয়া প্রয়োজন। পড়া আরও সহীহ ও সুন্দর করা দরকার।
মাদরাসায় যখন পড়তাম তখন অন্যান্য কিতাবের সাথে কোরআন শরীফেরও সবক হতো। সতেরোটি মাখরাজসহ অন্যান্য কায়দা—কানুন মুখস্থ করানো হতো। আমলী সূরাগুলো মুখস্থ করানো হতো। এরপর কোরআন শরীফের তরজমা ও তাফসীরও পড়ানো হয়েছে। এর বাইরে কিন্তু কোরআন তেলাওয়াত সুন্দর করার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এরপর নিজে যখন মাদরাসায় পড়িয়েছি তখন তো অন্যান্য কিতাব মুতালাআ নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতাম। বিয়ের পর সাংসারিক ঝামেলা নিয়ে কোরআন তেলাওয়াতের প্রতি অনেকটা শিথিলতা এসে গিয়েছিল। কাজের ফাঁকে কখনো মুখস্থ সূরাগুলো পড়েছি। কখনো কোরআন হাতে নিয়ে দশ—পনেরো মিনিট তেলাওয়াত করে রেখে দিয়েছি।
এখন আলহামদুলিল্লাহ চেষ্টা করি। তাই আল্লাহ তাআলা সহজ করে দিয়েছেন। চার সন্তান ও সাংসারিক কাজ একা হাতে সামলানোর পর যখন কোরআন নিয়ে বসি তখন অন্তরে অন্যরকম প্রশান্তি অনুভব করি। আসল কথা হলো, আমাদের চেষ্টা থাকতে হবে। তাহলে আল্লাহ তাআলা শত ব্যস্ততার মাঝেও সুযোগ করে দেবেন। সারা দিনে কোরআনের জন্য এক ঘণ্টা সময় বের করা কঠিন কিছু নয়। এক ঘণ্টা না পারি অন্তত আধা ঘণ্টা তো অবশ্যই বের করতে পারি।
আমরা মনে করি, মাদরাসায় পড়লেই বুঝি কোরআন সহীহ—শুদ্ধ হয়ে যায়। অথচ অনেক মেয়ে আছে যারা আলেমা হয়ে বের হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কোরআন মাজীদ তাদের অশুদ্ধই রয়ে যাচ্ছে। যাদের তেলাওয়াত সহীহ—শুদ্ধ আছে তাদের অনেকের তেলাওয়াতও মানোত্তীর্ণ নয়। এর চেয়েও দুঃখজনক হলো এর প্রতি যে গুরুত্বারোপ করা উচিত তাও আমাদের অনুভূতিতে নেই। তাই যারা মাদরাসায় পড়েন বা পড়ান অথবা আলেমা কিন্তু সংসার নিয়ে ব্যস্ত—তাদের সবার উচিত, নিজের তেলাওয়াত যাচাই করে দেখা। তেলাওয়াতে দুর্বলতা থাকলে তা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করা। তেলাওয়াত বিশুদ্ধ থাকলে তা আরও সুন্দর করার চেষ্টা করা। প্রতিদিন কিছু সময় কোরআন মাজীদ তেলাওয়াত করা।
এখন ইন্টারনেটের যুগ। সাংসারিক ঝামেলা বলেন আর মাদরাসায় পড়ানোর ব্যস্ততা বলেন, এর ফাঁকেই কিন্তু অনেক নারী দীর্ঘ সময় ফেসবুক, ইমু, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউবে ব্যস্ত থাকেন। কত মূল্যবান সময় তাতে নষ্ট হচ্ছে। অথচ আমরা ইচ্ছা করলে ইন্টারনেটের মাধ্যমেও পড়তে পারি। আমাদের সময় কাজে লাগাতে পারি। কোরআন সহীহ না হলে সেখানে প্রতিটি হরফের সহীহ উচ্চারণ ও মশক পাওয়া যায়। সেগুলো শুনতে পারি। তাতে সময়টা কাজে লাগবে। তবে আরও ফলদায়ক হবে যদি এমন কারও কাছে সময় দিতে পারি, যার তেলাওয়াত পরিপূর্ণ শুদ্ধ। দিনের কিছু সময় নিজে কোরআন নিয়ে বসুন। কোনো কারীর তেলাওয়াত শোনে তার সঙ্গে সঙ্গে পড়–ন। তাতে আপনার তেলাওয়াত আরও সুন্দর হবে। তেলাওয়াত শুদ্ধ হলেও বিভিন্ন কারীদের তেলাওয়াত শুনতে পারেন। কোরআন তেলাওয়াত শোনাও উপকারী। তাতে অন্তর নরম হবে।
কোরআন মাজীদের সঙ্গে সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে তুলুন। আপনি মা হলে কোরআনের সঙ্গে এই সুসম্পর্ক আপনার সন্তানদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। ছোট থেকেই তাদের অন্তরে কোরআনের মহব্বত ও আযমত সৃষ্টি হবে। আপনি মাদরাসার শিক্ষিকা হলে, নিজে বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করুন, ছাত্রীদেরকেও উৎসাহিত করুন। প্রতিটি ছাত্রীর তেলাওয়াতের দুর্বলতা কীভাবে কাটানো যায়, তার ফিকির করুন। তার জন্য আপনি চেষ্টা করুন। ছাত্রীদেরকে উৎসাহ দিন, তারা যেন প্রতিদিন কিছু সময় সুন্দরভাবে গভীর মনোযোগসহ কোরআন তেলাওয়াত করে। কোরআনের সঙ্গে যেন তাদের গভীর ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। এই ছাত্রীরা ভবিষ্যতে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়বে। তারা আমাদেরকে কোরআনের আলোয় আলোকিত সমাজ উপহার দেবে, ইনশাআল্লাহ।
—উম্মে আফিফা
২২ মে ২০২২ ঈসায়ী