প্রতিষ্ঠাতা: মুজাহিদে আযম হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.

জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ, ঢাকা-এর মুখপত্র

প্রতিষ্ঠাকালঃ ১৯৩৭ ঈসায়ী

হাকীমুল উম্মতের নসীহত রোযার হক আদায় করি এবং যাকাতের ব্যাপারে যত্নবান হই

হাকীমুল উম্মতের নসীহত রোযার হক আদায় করি এবং যাকাতের ব্যাপারে যত্নবান হই

সংকলক : মাওলানা যায়েদ মাজাহেরী

 

রমযানের রোযা রাখাও নামায—যাকাতের মতো ইসলামের একটি রুকন। অর্থাৎ বড় গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য একটি বিধান। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا كُتِبَ عَلَیْكُمُ الصِّیَامُ.

হে ঈমানদারগণ, তোমাদের ওপর রোযা ফরয করা হয়েছে।

হাদীস শরীফে রোযার অনেক সওয়াবের কথা বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ পাকের কাছে রোযাদারের মর্যাদা অনেক। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি রমযানের রোযা শুধু আল্লাহর জন্য সওয়াবের প্রত্যাশায় রাখবে, আল্লাহ পাক তার পেছনের সকল সগীরা গোনাহ মাফ করে দেবেন।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের সুগন্ধির চেয়ে প্রিয়। কেয়ামতের দিন রোযার অফুরন্ত সওয়াব মিলবে।

বর্ণিত আছে, কেয়ামতের দিন রোযাদারদের জন্য আরশের নিচে দস্তরখান বিছানো হবে। তারা সেখানে বসে খাবার খেতে থাকবে আর অন্যরা তখন নিজেদের হিসাব—কিতাব নিয়ে পেরেশান থাকবে। এই দেখে লোকেরা বলবে, এরা কারা যারা খাওয়া—দাওয়া করছে আর আমরা এখনো হিসাব—নিকাশে আটকে আছি? তাদের উত্তরে বলা হবে, এরা রোযা রাখত আর তোমরা রোযা রাখতে না।

রোযার মধ্যে একটি বিশেষ ব্যাপার আছে যা অন্য কোনো ইবাদতে নেই। তা হচ্ছে ব্যক্তির রোযাদার হওয়া না—হওয়ার খবর আল্লাহ ছাড়া কেউ জানতে পারে না। এ জন্য রোযা সেই রাখে যার ভেতর আল্লাহর মহব্বত কিংবা ভয় আছে। এতে সামান্য ঘাটতি থাকলেও অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, মহব্বত ও শ্রদ্ধা—ভক্তির কাজ করলে মহব্বত তৈরি হয়। আর তাই রোযার দ্বারা এই ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়। বলাবাহুল্য, যার অন্তরে আল্লাহর মহব্বত ও ভয় যত বেশি থাকবে সে দ্বীনের ওপর তত বেশি দৃঢ়পদ থাকবে। অতএব রোযা রাখার মধ্যে যে দ্বীন মজবুত হওয়ার বৈশিষ্ট্য আছে তা প্রমাণিত হলো।

 

রমযানের ফায়েদা

অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, রমযানের ইবাদতের প্রভাব পরবতীর্ এগারো মাসেও অবশিষ্ট থাকে। কেউ যদি রমযানে নিজের ওপর জোর খাটিয়েও কোনো নেকী (ও ইবাদত) করে ফেলে, তাহলে পরবর্তী সময়ে সহজে নেক কাজ করতে পারে। কেউ রমযানে কোনো গোনাহ থেকে বেঁচে থাকলে সারা বছর তার জন্য ওই গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হয়। এই মাসে গোনাহ ছাড়া কোনো কঠিন বিষয় নয়। কারণ, হাদীস শরীফে এসেছে, এই মাসে শয়তানকে বন্দি করে রাখা হয়। অতএব শয়তান যেহেতু বন্দি, গোনাহ এমনিতেই কমে যাবে আর গোনাহ ছেড়ে দেওয়া সহজ হয়ে যাবে। কেননা, গোনাহের প্রতি আগ্রহী করে দুই বস্তু : এক হচ্ছে শয়তান আর দ্বিতীয় হচ্ছে নফস। শয়তান যেহেতু বন্দিই, গোনাহের প্রতি আকর্ষণ করার মতো নফসই থেকে যায়। সুতরাং এটাকে দমন করাও সহজ। আগের মতো রমযানে একসঙ্গে দুটির মোকাবিলা করতে হয় না। এই এক মাসের জন্য নফসকে প্রতিরোধ করা কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। এই মাসে যদি গোনাহ ছেড়ে দেন তাহলে সারা বছর এর থেকে বেঁচে থাকা সহজ হয়ে যাবে। মোটকথা, এই মাসে প্রত্যেকটি অঙ্গকে গোনাহ থেকে বাঁচাতে হবে।

 

রোযার উদ্দেশ্য

আল্লাহ পাক এই মাসে সেসব জিনিসকেও হারাম করে দিয়েছেন যা আগে হালাল ছিল। তাহলে যা আগে থেকেই হারাম তা কী পরিমাণ হারাম হয়ে গিয়ে থাকবে? আল্লাহ পাক রোযা রাখার কারণ বলেছেন,

لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ.

রোযা এজন্য যাতে তোমরা পরহেযগার হয়ে যাও।

এখন সবাই ভেবে দেখুন, রমযানে আগের তুলনায় কত বেশি পরহেযগার হতে পেরেছেন, আগের অবস্থা আর বর্তমান অবস্থার মধ্যে কতটুকু পার্থক্য হয়েছে? বেপর্দা চলা বন্ধ হয়েছে কি না? গীবত তথা পেছনে অন্যের দোষচর্চা বর্জন করা হয়েছে কি না? কিন্তু দেখা যায়, কোনো কিছুই বর্জন করা হয়নি। রমযানে আগের অবস্থা ও রমযানের মধ্যের অবস্থা একই রকম। কোনো কিছুই কমেনি। শুধু একটা কাজ হয়েছে, খাবারের সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। খাবারের পরিমাণও কমেনি। আগে যতটুকু খেত রমযানেও ততটুকুই খাওয়া হয়।

আল্লাহ পাক আমাদের ওপর রোযা এজন্য ফরয করেছেন যাতে দোষ—ত্রুটি কমে যায়। কিন্তু আমরা কোনো কিছুই কমাইনি। আল্লাহওয়ালারা তো এই মাসে আহারও কম করেন। যাই হোক, খানা আগের মতো খাওয়া জায়েয কিন্তু গোনাহ তো কোনোভাবেই জায়েয নয়। কিন্তু আমাদের অবস্থা তো হচ্ছে দিনভর গোনাহে ডুবে থাকি; বরং অনেকে তো রমযানে গোনাহ আরও বাড়িয়ে দেয়। ব্যাপারটি এভাবে যাচাই করে দেখে নিন, পাঁচ ওয়াক্ত নামায যথাসময়ে হচ্ছে কি না? বেশিরভাগেরই নামায দেরি করে পড়ার অভ্যাস হয়ে গেছে। (বিশেষভাবে নারীরা খাবার ও ইফতারী তৈরি করতে গিয়ে আসরের নামায অনেক দেরি করে পড়ে।) অনেকের তো নামায কাযা হয়ে যায়। কাযা না হলেও দেরি তো অবশ্যই হয়। এরপরও আনন্দিত যে, আমি রোযা রেখেছি। আশ্চর্য কথা হচ্ছে, যে নামায ছেড়ে দিচ্ছে, শুধু রোযা তার জন্য কীভাবে যথেষ্ট হয়।

 

রোযায় নারীদের ত্রুটি

নারীদের কাছে রোযা কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। এ ক্ষেত্রে তারা মাশাআল্লাহ পুরুষদের চেয়ে অগ্রসর। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নারীরা রোযা অনেক রাখে। কিন্তু নামাযের বেলায় যেন তাদের জান বের হয়ে যায়। আর রোযা রাখা নারীদের কোনো কৃতিত্বও নয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের আলোকে এর একটি ব্যাখ্যা আছে। তা হচ্ছে, নারীদের প্রকৃতিতে আর্দ্রতার মাত্রা প্রবল। আর আর্দ্র প্রকৃতির মানুষের সৃষ্টিগতভাবে ক্ষুধা—পিপাসা কম লাগে। তাই তাদের পক্ষে রোযা রাখা সহজ হয়।

দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, তারা খাবার—দাবার নিয়ে ব্যস্ত থাকে। নিজ হাতে খাবার রান্না করে। খাবারের ঘ্রাণ নাকে আসতেই থাকে। এ জন্য তাদের ক্ষুধা চলে যায়। শুধু পিপাসার কষ্ট থেকে যায়। পিপাসার কষ্টও সহ্য করা তাদের জন্য কঠিন কিছু নয়। প্রথমত তাদের ওই স্বভাবজাত আর্দ্রতা পিপাসাকে কমিয়ে দেয়। দ্বিতীয়ত তারা দিনভর ঘরেই থাকে। রোদে বের হতে হয় না।

একটি ব্যাপার থেকে যায়, রান্না করার জন্য তো আগুনের সামনে বসতে হয়। এ ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি এমন, অনেক রোযাদার নারী নিজের হাতে কমই রান্না করে। তাদের সঙ্গে খেদমতের জন্য চাকরানিরা থাকে। যাদের নিজেদের কাজ করতে হয় তারা এই পদ্ধতিতে রান্না করে, প্রথমে তরকারি রান্না করে, যার জন্য আগুনের সামনে বসে থাকতে হয় না। একবার আগুন ধরিয়ে পাতিল রেখে দেয়, তারপর হাঁটা—চলার মধ্যেই রান্না করে ফেলে। তারপর যখন আসরের সময় হয়, গরম কমে যায়, তখন তাড়াতাড়ি করে পনেরো—বিশ মিনিটে রুটি তৈরি করে ফেলে। এ জন্য তাদের খাবার রান্না করতে বেশি সময় লাগে না।

নারীদের জন্য রোযা সহজ হওয়ার         তৃতীয় কারণ হচ্ছে, সাধারণত নারীদের খাবারের প্রতি লোভ কম থাকে। ভালো খাবারে তাদের এত আগ্রহ থাকে না। তাদের হাড়ি—পাতিলে শুধু পুরুষ ও বাচ্চাদের জন্য খাবার তৈরি হয়। কখনো পুরুষ লোক বাড়িতে না থাকলে চাটনি দিয়েই (কিংবা ডাল—ভাত দিয়ে) চালিয়ে নেয়। তো নারীরা যেহেতু নফসকে দমন করতেই থাকে, তাই ধীরে ধীরে তার ক্ষুধাও দমে যায়। এ জন্য রোযা রাখতে পারা তাদের জন্য বড় কোনো কৃতিত্বের বিষয় নয়; বরং পুরুষদের জন্য ব্যাপারটি কৃতিত্বের। কারণ, প্রচুর খাওয়ার চাহিদা সত্ত্বেও তারা রোযা রাখে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে পুরুষরা এখন রোযার সাহস হারিয়ে ফেলেছে।

আমি নারীদের এ কথা বলি না যে, তারা রোযা রাখে না। তবে অবশ্যই রোযা অবস্থায় গীবত থেকে বিরত থাকতে বলব। কারণ নারীদের রোযা খুব কমই গীবত থেকে পবিত্র হয়। রোযার সময় যখন খাবার রান্না করার ব্যস্ততা কম থাকে তখন তারা আড্ডা জমিয়ে এর—ওর গীবত—শেকায়েত করে রোযা বরবাদ করে। এমনিতেই তো গীবত সর্বাবস্থায় হারাম; কিন্তু রোযা অবস্থায় এর গোনাহ কয়েক গুণ বেশি হয়। যেমন যিনা করা হারাম। মক্কা—মুকাররামায় করা আরও জঘন্য অপরাধ। কারণ, স্থান ও কালের মর্যাদা বিবেচনায় যেমন ভালো কাজের সওয়াব বৃদ্ধি পায়, তেমনই মন্দ কাজে গোনাহের পরিমাণও বেড়ে যায়।

পানে অভ্যস্ত কিছু নারী এই ভুল করে, সেহরীর সময় মুখে পান নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এ অবস্থায় যদি সকাল পর্যন্ত মুখে পান থাকে তাহলে রোযা হয় না। এ কাজ অবশ্য পরিত্যাজ্য।

রোযার ব্যাপারে তো নারীরা খুবই সাহসী। এমনকি অসুস্থতা অথবা কষ্ট থাকলেও এবং চিকিৎসক (রোযা ভাঙার) পরামর্শ দিলেও তারা রোযা কাযা করে না। কিন্তু সেই সঙ্গে তারা গীবতও করে। যেহেতু সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কোনো কাজ থাকে না, তাই বসে বসে এদিক সেদিকের কথার পিঠে কথার জাল বুনতে থাকে। এ জন্য তাদের মধ্য থেকে সেসব নারী (রোযার সময়) অনেক ভালো, যারা তামাকে অভ্যস্ত হওয়ায় রোযা অবস্থায় খুব কাহিল হয়ে পড়ে। (যদিও তামাক খাওয়া খুবই মন্দ একটা কাজ)। কারণ রোযা রেখে তারা ঘরের এক কোনে পড়ে থাকে। পান মুখে না দিলে কথা বলাও তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে যায়। ফলে গীবত ইত্যাদি থেকে তারা নিরাপদ থাকে।

অতএব রোযার প্রতি নারীদের উৎসাহিত করার প্রয়োজন নেই। নারীরা রোযা খুব আগ্রহের সঙ্গে রেখে থাকে। তবে অবশ্যই রোযার হক আদায়ের ব্যাপারে নারীদেরকে তাকিদ করব যে, অযথা গোনাহের কথাবার্তায় মজে থেকে রোযাকে ধ্বংস করবেন না। বরং কোরআনে কারীম তিলাওয়াত করুন। বুযুর্গদের ঘটনা শুনুন। এও সম্ভব না হলে এক কোনে শুয়ে থাকুন।

 

এতেকাফ

রমযানুল মুবারকের বিশ তারিখের দিন শেষ হওয়ার কিছু আগ থেকে রমযানের ঊনত্রিশ অথবা ত্রিশ তারিখ অর্থাৎ যে দিন ঈদের চাঁদ দেখা যাবে ওই দিন শেষ হওয়া পর্যন্ত নামাযের নির্ধারিত জায়গায় পাবন্দির সঙ্গে অবস্থান করুন। এটাকে এতেকাফ বলে। এটা অনেক বড় সওয়াবের কাজ।

আলী বিন হুসাইন রাযি. নিজ বাবা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি রমযানের দশ রোযার এতেকাফ করবে তাকে দুই হজ ও দুই ওমরার পরিমাণ সওয়াব দেওয়া হবে।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতেকাফকারীদের ব্যাপারে বলেছেন, তারা সব ধরনের গোনাহ থেকে বিরত থাকে। তাকে এত সওয়াব দেওয়া হয় যেন সে সব ধরনের ইবাদত করছে।

নারীরা ঘরেই নিজ নামাযের জায়গায় এতেকাফ করবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর স্ত্রীগণও এতেকাফ করতেন।

এতেকাফ শুরু করার পর প্রাকৃতিক প্রয়োজনে অথবা খাওয়া—দাওয়ার জন্য সেখান থেকে উঠা যাবে, আর যদি খাবার এনে দেওয়ার মতো কেউ থাকে তাহলে খাবারের জন্যও উঠবে না। সব সময় এ জায়গাতেই থাকবে। এখানেই ঘুমাবে। উত্তম হলো অবসর থাকবে না। কোরআন পড়তে থাকবে। তাওফীক অনুযায়ী নফল ও তাসবীহ আদায়ে মগ্ন থাকবে। হায়েয অথবা নেফাস শুরু হয়ে গেলে এতেকাফ ছেড়ে দেবে। এ অবস্থায় এতেকাফ জায়েয নয়। এতেকাফ অবস্থায় স্বামীর সঙ্গে মেলা—মেশাও জায়েয নয়।

 

সদকায়ে ফিতর

এক. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রমযানের শেষদিকে তিনি বলেন, রোযার সদকা আদায় করো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই সদকা প্রত্যেক নেসাবওয়ালার জন্য নির্ধারিত করেছেন, চাই সে গোলাম অথবা স্বাধীন ব্যক্তি কিংবা পুরুষ অথবা নারী, শিশু বা বৃদ্ধ।

দুই. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমাদের মধ্যে যারা সম্পদশালী তারা যেন সদকায়ে ফিতর আদায় করে। কারণ সদকায়ে ফিতর আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহ পাক রোযাগুলো পবিত্র করে দেন। যারা গরিব হওয়া সত্ত্বেও সদকায়ে ফিতর আদায় করবে আল্লাহ পাক তাকে তার দানের চেয়েও বেশি দেবেন।

তিন. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকায়ে ফিতর এ জন্য নির্ধারণ করেছেন যাতে রোযা অশ্লীল কাজকর্ম ও কথাবার্তা থেকে পবিত্র হয়ে যায় আর গরিবদেরও অন্ন সংস্থান হয়।

 

যাকাতের বয়ান

যাকাতের গুরুত্ব : নামাযের মতো যাকাতও ইসলামের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য একটি বিধান। অনেক আয়াতে যাকাত আদায়ের বিধান, যাকাত আদায়ের সওয়াব এবং যাকাত না দেওয়ার শাস্তির কথা উল্লেখ হয়েছে।

এক. হযরত আবুদ দারদা রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, যাকাত ইসলামের একটি পুল অথবা একটি উঁচু অট্টালিকা। যাকাত আদায় না করলে ইসলামের ওপর চলতে পারবে না।

দুই. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমাদের ঠিকভাবে নামায পড়ার ও যাকাত আদায়ের হুকুম দেওয়া হয়েছে। যে ব্যক্তি যাকাত দেবে না তার নামায কবুল হবে না।

তিন. আরেক বর্ণনায় আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি ঠিকমতো নামায পড়ে কিন্তু যাকাত দেয় না সে পূর্ণাঙ্গ মুসলমান নয় যে, তার নেক আমল তার উপকারে আসবে।

(যব, খেজুর, পনির বা কিসমিস দিয়ে ফিতরা আদায় করলে ৩২৭২ গ্রাম বা তার মূল্য। আর গম দিয়ে আদায় করলে ১৬৩৬ গ্রাম বা তার মূল্য। প্রত্যেকে নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী এ পাঁচ প্রকার শস্যের কোনো একটির মূল্য ধরে ফিতরা আদায় করবে।)

 

যাকাত সম্পর্কে নারীদের প্রতি সতর্কবার্তা

যে নারীর কাছে সম্পদ থাকা সত্ত্বেও যাকাত দেয় না আল্লাহর কাছে সে বড় গোনাহগার। কেয়ামতের দিন তার কঠোর শাস্তি হবে।

হযরত আসমা রাযি. বলেন, আমি এবং আমার খালা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর কাছে সোনার চুড়ি পরা অবস্থায় উপস্থিত হই। তা দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা কি এগুলোর যাকাত আদায় করো?

আমরা বললাম, না!

তিনি বললেন, তোমাদের কি এ ব্যাপারে ভয় হয় না যে, আল্লাহ তোমাকে আগুনের চুড়ি পরাবেন? এর যাকাত আদায় করো।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যার কাছে সোনা, রুপা রয়েছে কিন্তু সে যাকাত দেয় না, কেয়ামতের দিন তার জন্য আগুনের পাত বানানো হবে। তারপর সে পাতকে দোযখের আগুনে উত্তপ্ত করে দুই পার্শ্ব, কপাল ও পিঠে দাগ দেওয়া হবে। যখন ঠান্ডা হয়ে যাবে তখন আবার উত্তপ্ত করা হবে।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, যাকে আল্লাহ পাক সম্পদ দিয়েছেন, তারপরও সে যাকাত আদায় করেনি, কেয়ামতের দিন তাদের সম্পদকে একটি বড় বিষধর কালো সাপের আকৃতি দেওয়া হবে এবং বেড়ির মতো করে তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার গলায় লেপ্টে যাবে এবং তার উভয় চোয়ালে দংশন করতে  থাকবে আর বলবে, আমি তোমার সম্পদ, তোমার ধনভান্ডার।

আল্লাহ পানাহ, এত আযাব সহ্য করার ক্ষমতা কার আছে! সামান্য লোভের কারণে এই ভোগান্তিতে পড়া একেবারেই বোকামি। আল্লাহ পাকের দেওয়া সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় না করা কত অযৌক্তিক কথা।

যাকাতের ব্যাপারে নারীদের অবহেলা

যাকাতের ক্ষেত্রে নারীরা অনেক অবহেলা করে। তারা তাদের গয়না, মুকুট ইত্যাদির যাকাত আদায় করে না। মনে রাখবেন, যতটুকু স্বর্ণ বাবার বাড়ি থেকে পায় তা তার মালিকানাধীন হওয়ায় ওই অলংকারটুকুর ওপর যাকাত ফরয হয়। যেটা স্বামীর বাড়ি থেকে পায় সেটা যদি তাকে মালিক বানিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তাতেও যাকাত আসবে। যদি শুধু ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়, তাহলে এর যাকাত দাতাদের ওপর ফরয হবে। প্রতি বছর নিজ স্বর্ণ—অলংকারের হিসাব করে যত যাকাত আসে তা দিয়ে দেবে। এ ব্যাপারে অবহেলা করলে গোনাহ হয়।

দেখুন, আল্লাহ পাক অনেক দরিদ্রকে সম্পদ দেননি। অথচ আপনি তাদের চেয়ে বিশেষ কোনো কৃতিত্বের অধিকারী কেউ নন। বেশিরভাগ দরিদ্র কীর্তি ও কামালের দিক দিয়ে আপনার চেয়ে ঊর্ধ্বে। কারণ, তারা নামাযীও, দ্বীনদারও। তারপরও আল্লাহ তাদের ধন—দৌলত দেননি। দিয়েছেন আপনাকে। এর কারণ কী? আল্লাহ পাক ধনীদের সম্পদ দিয়েছেন যেন তারা গরিবদের দান করে। কারণ, প্রত্যেক ব্যক্তি ততটুকু সম্পদেরই হকদার যতটুকু তার প্রয়োজন। আল্লাহ পাক যাকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি দিয়েছেন তা তাকে সঞ্চয় করে রাখার জন্য দেননি। বরং যাদের প্রয়োজন পরিমাণও মিলেনি তাদের দেওয়ার জন্য দিয়েছেন। এর মধ্যে আল্লাহ পাকের অনেক হেকমত রয়েছে। আল্লাহ পাক গরিবদেরকে ধনীদের মাধ্যমে দিতে চান। এই নিয়মের দাবি অনুযায়ী তো এমন হওয়া উচিত ছিল, প্রয়োজন পরিমাণ রেখে বাকি সব গরিবদের দিয়ে দেবে। কারণ, যৌক্তিক বিবেচনায়ও এটি তাদের হক। কিন্তু কত বড় রহমত যে, সব সম্পদ দান করতে বলেননি; বরং শুধু চল্লিশ ভাগের একভাগ ফরয করেছেন। তারপরও এটুকু নিয়ে অবহেলা করা অনেক বড় অন্যায়।

মুসলমানদের জাহেরী—বাতেনী বেশিরভাগ পেরেশানির কারণ হচ্ছে দারিদ্র্য ও অভাব। যাকাত এ সমস্যার যথেষ্ট সমাধান। ধনীরা যদি অপচয় না করে, সামর্থ্যবান লোকেরা পরিশ্রম করে, অসহায় লোকরা যাকাত সহায়তা পেতে থাকে তাহলে মুসলমানদের মধ্যে একজনও অন্ন ও বস্ত্রহীন থাকত না। যাকাতের সবচেয়ে বেশি হকদার হচ্ছে গরিব আত্মীয়—স্বজন। চাই তারা এলাকার হোক কিংবা দূরের। তাদের পরে হচ্ছে নিজ এলাকার অন্যান্য গরিব। যদি অন্য এলাকার লোকেরা বেশি গরিব হয় তাহলে তারাই বেশি হকদার।

 

অধিকাংশ নারীর অভ্যাস

অধিকাংশ নারী যাকাত দেয় না। কারণ টাকা খরচ হবে। কখনো এমন হয়, অলংকারের যাকাত পুরুষও আদায় করে না, মহিলাও আদায় করে। পুরুষ বলে, অলংকার নারীর আর নারী বলে দেয় অলংকার তো পুরুষের, আমি কেন যাকাত দিতে যাব। যার সম্পদ সে দেবে। এই বাহানায় কিন্তু আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচতে পারবে না। যেভাবেই হোক শেষ পর্যন্ত কোনো একজনের তো অবশ্যই। সে হিসেবে তার ওপর যাকাত আসবে। দুজনের হয়ে থাকলে প্রত্যেকে নিজ নিজ অংশের যাকাত দেবে। যদি সত্যিই কারও না হয়ে থাকে, তাহলে এই সম্পদ আল্লাহর। সুতরাং ওয়াক্ফের খাতে মসজিদ অথবা মাদরাসায় দিয়ে দেবে, নাহয় গরিবদের বণ্টন করে দেবে।

 

যাকাত আদায়ে সম্পদ কমে যায় এই সংশয়ের জবাব

বেশিরভাগ ধনী এ জন্য যাকাত দিতে অবহেলা করে যে, যাকাত দিলে টাকা—পয়সা কমে যাবে।

প্রথম কথা হচ্ছে, এ ব্যাপারটি পরীক্ষিত যে, যাকাত, সদকা আদায় করলে সম্পদ কখনই কমে না। যাকাত আদায়ের মুহূর্তে কিছু চলে গেলেও পরক্ষণেই এরচেয়ে বেশি চলে আসে। হাদীস শরীফেও এ বিষয়টি আছে।

দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, কথার কথা যদি সম্পদ কমেও যায়, তাতে আর কী? নিজের স্বাদ—আহ্লাদ পূরণের জন্য তো হাজার হাজার টাকা খরচ করি। এতেও তো সম্পদ কমে। সরকারি টেক্স ও মাসূলও তো অনেক দিতে হয়, না দিলে ঋণখেলাপি ও অপরাধী আখ্যায়িত করা হয়। শেষ পর্যন্ত এভাবেও তো সম্পদ কমে, তাহলে যাকাতকেও খোদায়ী টেক্স মনে করে নাও।

তৃতীয় কথা হলো, দুনিয়াতে বাহ্যিকভাবে কম হয়ে যায় মনে হলেও আখেরাতে তা জমা হয়। পোস্ট অফিসে, ব্যাংকে টাকা জমা রাখলে নিজ হাত থেকে তো চলে যায় কিন্তু এদিক থেকে আশ্বস্তি লাগে যে, একটি নির্ভরযোগ্য জায়গায় জমা হয়েছে এবং লভ্যাংশ বাড়তে থাকবে। ঈমানদারেরও এভাবেই আল্লাহ পাকের ওয়াদায় বিশ্বাস করে বুঝতে হবে, আখেরাতে জমা হচ্ছে। কেয়ামতের দিন মূলধন লভ্যাংশসহ এমন পরিস্থিতিতে পেয়ে যাবে, যেদিন এই জিনিসের খুব প্রয়োজন হবে।

এ ছাড়া সম্পদের হেফাজতের জন্য বেতন দিয়ে পাহারাদার রাখতে হয়। বেতন দেওয়ার কারণে টাকা—পয়সা কমে কিন্তু এই ভয়ে চাকর রাখতে হয় যে, অল্প কিছু বাঁচানোর জন্য সবকিছুই না চুরি হয়ে যায়। সম্পদ পাহারার জন্য কিছু ব্যয় করা সয়ে নেওয়া হয়। তদ্রূপ যাকাত প্রদানকে সম্পদ হেফাজতের সহায়ক মনে করুন।

হাদীস শরীফ থেকে জানা যায়, যাকাত না দিলে সম্পদ ধ্বংস হয়ে যায়। (এ জন্য কখনো না কখনো বিপদ—মুসিবত অবশ্যই আসে।)

হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে সম্পদের সঙ্গে যাকাত মিশ্রিত হয় যাকাত সে সম্পদকে ধ্বংস করে দেয়।

আরেক বর্ণনায় আছে, যদি তোমার ওপর যাকাত ফরয হয় কিন্তু তুমি তা আদায় না করো, তাহলে এই হারাম অংশ হালাল অংশকেও ধ্বংস করে দেয়।

সুতরাং নিজের সম্পদ হেফাজতের জন্য যাকাত আদায় করুন। প্রত্যেককেই অভাবীদের জন্য কিছু না কিছু খরচ করতে হয়। হিসাব করে খরচ করলে যাকাত খুব সহজেই আদায় হয়ে যায়।

[ইসলাহে খাওয়াতীন থেকে অনুবাদ করেছেন, মায়মূনা]

লেখক সম্পর্কে
Avatar

zobayer

একটি কমেন্ট করুন