হাকীমুল উম্মত : স্মৃতি ও অভিব্যক্তি
স্মৃতিকথা
মাওলানা আব্দুল মাজেদ দরিয়াবাদী রহ.
সাতষট্টি
এই সময়ে মূল বিষয় তাফসীরে কোরআনই ছিল। ২৩ জুনের চিঠিতে এ ছাড়া আর কোনো বিষয়ই ছিল না। এ জন্য এটা আবশ্যক নয় যে এখানকার চিঠি আর ওখানকার জবাব সবাই পুরোপুরি যে বুঝবে বা সবার আগ্রহের বিষয় হবে। কিছু অংশ শুধু তালিবে ইলমদের জন্য থাকা উচিত। সূরা বাকারা, পারা : ২; আয়াত ১৯২—এ যুদ্ধের ব্যাপারে এরশাদ হয়েছে,
فَاِنِ انْتَهَوْا فَاِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ
যদি তারা ক্ষান্ত হয় তাহলে আল্লাহও বড় ক্ষমাশীল ও বড় দয়ালু।
প্রশ্ন হলো, কাফেররা কোন জিনিস থেকে ফিরে আসবে? যুদ্ধ থেকে না কুফরী আকীদা থেকে? প্রশ্নটি বড়ই বিরোধপূর্ণ। নিম্নে প্রশ্ন এবং অনেক বিস্তারিত জবাব দেখুন।
প্রশ্ন : আপনাদের অনুসরণ করে فَاِنِ انْتَهَوْا (যদি তার ক্ষান্ত হয়) এর তাফসীর করেছি عن الكفر (কুফর থেকে) দিয়ে। কিন্তু আরেক দলের জোর দাবি হলো, তাফসীর কেবল عن القتال (যুদ্ধ থেকে) দিয়ে করা উচিত। তাদের বক্তব্য হলো, কাফেরদের পক্ষ থেকে যুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণেই কেবল মুসলমানদেরকে যুদ্ধের আদেশ দেওয়া হয়। যখন তারা নিজেরাই যুদ্ধ বন্ধ করে দেয় তখন মুসলমানদেরও থেমে যাওয়া উচিত।
তারা সামনে অগ্রসর হয়ে وَّیَكُوْنَ الدِّیْنُ لِلهِ (তরজমা) এর তাফসীরে বলেন, এ দিয়ে উদ্দেশ্য শুধু এটুকুই যে মানুষ ইসলাম গ্রহণ করা এবং ইসলামের উপর অবিচল থাকার স্বাধীনতা লাভ করতে পারে। এ অর্থ নয় যে, সারা দেশে কেবল ইসলাম আর ইসলামই থাকবে। তারা নিম্নোক্ত দলীল পেশ করেন :
এক. কোরআন মাজীদের অন্য আয়াত এ বিষয়টিকে সমর্থন করে। যেমন,
وَاِنْ جَنَحُوْا لِلسَّلْمِ فَاجْنَحْ لَهَا
এমন আরও আয়াত আছে।
দুই. নবীজির আমলও এ বিষয়টিকে সমর্থন করে। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুদায়বিয়াতে কাফেরদের শর্তমতেই সন্ধি করেন। মক্কাবিজয়ের সময় মক্কাবাসীকে তাদের কুফরি বিশ্বাস সত্ত্বেও মাফ করেছেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর জীবন—সায়াহ্ন পর্যন্ত মুশরিকদের প্রতিনিধি আসতে থাকে। নবীজির ইন্তিকাল কী, তার পরেও তো ইহুদী—নাসারা আরবে বসবাস করে।
জনাবের সময় দিতে সমস্যা না হলে নিবেদন হলো, সংক্ষিপ্ত ইঙ্গিতের মাধ্যমে দিক—নির্দেশনা দিয়ে বাধিত করবেন।
হযরতের পক্ষ থেকে দিক—নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু সম্ভবত আমার লেখার প্রতি লক্ষ করে ছোট্ট ইঙ্গিত নয়; বরং সবিস্তার ও সপ্রমাণ বিবরণ—সংবলিত একটি পূর্ণ প্রবন্ধই এ বিষয়ে লিখে দেন।
উত্তর : যারা এ জোর দাবি করছেন তাদের হয়তো মুজতাহিদগণের মতামত জানা নেই। انْتَهَوْا এর তাফসীরে عن الكفر দেখে ভুল বুঝে বসে আছে যে, আহলে হক হয়তো ইসলাম গ্রহণ ছাড়া যুদ্ধ বন্ধের পক্ষে নয়। অথচ ইমামগণের এ মত নয়। তারা যুদ্ধের উদ্দেশ্য অন্য কিছুকে আখ্যা দেন। এক হলো, জিযিয়া দেওয়ার শর্তে বশ্যতা স্বীকার করা। انْتَهَوْا এর তাফসীরে عن الكفر বলা এ ভিত্তিতে নয় যে ইসলাম গ্রহণ ছাড়া যুদ্ধ বন্ধ করা যাবে না। এটা তো তাদের মাযহাব পরিপন্থী। যার উল্লেখ মাত্রই গত হলো।
এ তাফসীরের ভিত্তি হলো, এ আয়াত আরবদের বিশেষ একটি গোষ্ঠীর ব্যাপারে নাযিল হয়েছে, যাদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির চুক্তি হয়েছিল। মুসলমানরা তাদের পক্ষ থেকে চুক্তি ভঙ্গের আশঙ্কা করছিল। তাদের ব্যাপারে বিশেষ করে আল্লাহ পাক বলেছেন, তাদের বিরুদ্ধে তোমরা নিজেরা যুদ্ধ শুরু কোরো না। চুক্তি লঙ্ঘন করে তারা যদি যুদ্ধ শুরু করে তাহলে যুদ্ধের অনুমতি আছে। আর যদি সেসব কাফের চুক্তি ভঙ্গের পর এবং নিজ থেকে যুদ্ধ শুরু করার পর ইসলাম গ্রহণ করে নেয়—যার কারণে যুদ্ধ পরিহার করতে হয়, তাহলে আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন এবং তোমরাও যুদ্ধ থেকে বিরত থাকো।
আয়াতে غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ বলা থেকে বোঝা যায় এ তাফসীরই অগ্রগণ্য হবে। কারণ, শুধু যুদ্ধ থেকে বিরত থাকাই আল্লাহর ক্ষমা লাভের কারণ হতে পারে না। কিন্তু এ তাফসীর বেছে নেওয়ার অর্থ এই নয় যে কুফর থেকে বিরত না হলে যুদ্ধ অব্যাহত রাখা হবে। উদ্দেশ্য হলো, এখানে এই তাফসীর উপযুক্ত। তবে কুফর থেকে বিরত না হয়ে যদি যুদ্ধ থেকে বিরত হয় তাহলে কী হবে—এ তাফসীর হিসাবে আয়াতে এ সুরতটি অনুক্ত। এ সুরতের হুকুম যথাস্থানে অন্যান্য দলীলাদির মাধ্যমে প্রমাণিত। আর তা হলো ইসলাম গ্রহণের দরুন যুদ্ধ থেকে বিরত হলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। আর কুফর ও ইসলাম বিরোধিতা সত্ত্বেও যদি যুদ্ধ থেকে বিরত হয় তাহলে মুসলমানদের জন্য যুদ্ধ অব্যাহত রাখার অনুমতি আছে। এরপর যুদ্ধের যে উদ্দেশ্য বলা হয়েছে حَتّٰی لَا تَكُوْنَ فِتْنَۃٌ যেহেতু এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কারণ নির্ধারিত আরবরা ছিল যেমনটা বর্ণনায় এসেছে (বয়ানুল কোরআনে তা—ই উল্লেখ আছে) এ কারণে ইমাম সাহেবের নিকট ফেতনার ব্যাখ্যা কুফর দিয়ে করা যথার্থ। কারণ, তার মতে আরব কাফেরদের থেকে জিযিয়া নেওয়া হয় না। অন্যান্য কাফেরদের বেলায় ইমাম সাহেব হুকুম বর্ণনা করেননি। অন্যান্য ইমামদের মতে ফেতনার ব্যাখ্যা হলো, যুদ্ধ করার শক্তি। শক্তি নিঃশেষের একটি সুরত হলো, বশ্যতা স্বীকার।
সারকথা হলো, কাফেরদের যুদ্ধবিরতি মুসলমানদের যুদ্ধবিরতিকে আবশ্যক করে না। যেমনটা জোরালো দাবিদারদের মতামত থেকে জানা যায়। যা কোরআন, হাদীস ও ইজমার বিপরীত হওয়ার দরুন পরিত্যাজ্য। এই অগ্রহণযোগ্য মতামতের উপর ভিত্তি করেই حَتّٰی لَا تَكُوْنَ فِتْنَۃٌ এর তাফসীর করেছে। যা ভুলের উপর ভুলের ভিত্তি স্থাপনের পর্যায়ে পড়ে। কারণ সুস্পষ্ট, এই যে স্বাধীনতা যেটাকে তারাও জরুরি মনে করে, শুধু যুদ্ধবিরতির দ্বারাই তা অর্জিত হতে পারে না। যতক্ষণ না তাদের শক্তি নিঃশেষ করে দেওয়া হয়। নতুবা সব সময়ই আশঙ্কা থেকে যাবে নিজেদের শক্তি কাজে লাগানোর এবং মুসলমানদের স্বাধীনতা হরণের।
আর وَ اِنْ جَنَحُوْا لِلسَّلْمِ আয়াত দ্বারা যে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে সে ব্যাপারটি হলো, যদি নির্দেশটি অত্যাবশ্যক বিধানের জন্য হয় তাহলে এটি রহিত। রহিত বলা না হলে নির্দেশটি শুধু বৈধতা সাব্যস্ত করার জন্য। এর উপর আমল করা হবে কল্যাণ বিবেচনায়। আর تعامل দ্বারা যে দলীল পেশ করা হয়, তাতে ইমাম সাহেবের মাযহাব অনুযায়ী তো কোনো আপত্তিই নেই। তার মতে বসবাস ও প্রভাব বিস্তার ব্যতীত কাফেররা আরব উপদ্বীপে প্রবেশ করতে পারবে। অন্য ইমামগণ বলেন, কাফেরদেরকে আরব উপদ্বীপ থেকে বহিষ্কারের নববী নির্দেশ এ تعامل কে রহিত করে দিয়েছে। যাই হোক এ ব্যাপারে সবাই একমত, মুসলমানদের স্বার্থ ও সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বশ্যতা স্বীকার তথা জিযিয়া দিতে রাজি না হলে যুদ্ধ বন্ধ করা না ওয়াজিব, না—জায়েয। তো সে দলের দাবি কোনোভাবেই প্রমাণিত হয় না। তাদের কাছে যখন ইমামদের তাহকিক যথেষ্ট নয় তখন নিজেদের দাবি যথার্থ হওয়ার দাবি করার কী অধিকার আছে।
জবাবের সারমর্ম হলো, فَاِنِ انْتَهَوْا فَاِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ আয়াতে যদি انْتَهَوْا এর তাফসীর عن الكفر করা হয় এ ভিত্তিতে যে যুদ্ধবিরতি নির্ভর করে ইসলাম গ্রহণের উপর, তাহলে এ তাফসীর সঠিক নয়। কারণ, ইসলামে জিযয়া দিতে সম্মত হওয়াও যুদ্ধবিরতির কারণ হতে পারে। তাফসীর যদি করা হয় এ ভিত্তিতে যে ইসলামও সার্বিকভাবে যুদ্ধবিরতির অনেক কারণের একটি কারণ তাহলে তাফসীর সব ইমামের মতে ঠিক আছে। যদি এ ভিত্তিতে হয় যে—যুদ্ধবিরতি ইসলামের ওপর নির্ভরশীল নয়। কিন্তু আয়াত যাদেরকে কেন্দ্র করে অবতীর্ণ তাদের ইসলাম গ্রহণের উপর যুদ্ধবিরতি নির্ভর করে তাহলে এ মত শুধু ইমাম আবু হানিফা রহ. এর নিকট সহীহ। কারণ, তার মতে আরব কাফেরদের থেকে জিযয়া গ্রহণ করা হয় না। এ তাফসীর হলো انْتَهَوْا এর তাফসীর عن الكفر দিয়ে করলে। عن القتال দিয়ে করা হলে কথা হলো, যদি এ ভিত্তিতে করা হয়, জিযয়া গ্রহণ ছাড়াই যুদ্ধবিরতি ওয়াজিব হয় তাহলে নুসূস ও ইজমাবিরোধী হওয়ায় এ ব্যাখ্যা সহীহ নয়। আর যদি জিযয়া গ্রহণের শর্তে যুদ্ধবিরতি ওয়াজিব হয় তাহলে ব্যাখ্যা সঠিক।
মোটকথা হলো, নুসুস ও اجماع بسبط অথবা مركب দ্বারা প্রমাণিত বিষয়গুলো রক্ষা করে উভয় তাফসীরের অবকাশ আছে। এসব উপেক্ষা করে কোনো তাফসীর সঠিক নয়।
সময়ের বড় ফেতনাগুলোর মধ্যে একটি ফেতনা বেশ প্রসার লাভ করেছে। তা হলো, মুসলিম নারীরা স্বামীর দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে তার থেকে মুক্তি লাভ করতে চায়। কিন্তু রাষ্ট্র মুসলমানের নয়। খুলা’ কীভাবে হবে? এসব ভেবে মহিলারা মুরতাদ হয়ে যায়। ফলে আপনা—আপনিই বিয়ে ভেঙে যায়। স্বামী থেকে মুক্ত হয়ে সে পুনরায় ইসলাম গ্রহণ করতে পারে। এ কর্মপন্থা যে কতটা বিপজ্জনক তা একবারেই সুস্পষ্ট। যে কারণেই হোক, ইরতিদাদ একজন মুসলমানের জন্য কল্পনা করাও ভয়াবহ! তা ছাড়া ইরতিদাদের পর দ্বিতীয়বার ইসলামে ফিরে আসতে খোদা মালুম কত বাধা সামনে আসতে পারে। মাওলানার দৃষ্টি দ্বীন ও দুনিয়াবি প্রয়োজনের সকল ক্ষেত্রেই নিবব্ধ থাকে। একটি স্বতন্ত্র পুস্তিকা অনেক অনুসন্ধিৎসার পর এ বিষয়ে রচনা করেন। অথচ এ সময়ে তিনি রচনা ও সংকলন থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে মহিলা অত্যাচারী অথবা অসভ্য স্বামী থেকে পরিত্রাণ কীভাবে লাভ করবে তার ফিকহী পদ্ধতি বিস্তারিত লেখেন। পুস্তিকা আমার কাছেও পাঠান। সঙ্গে এ ফরমায়েশও ছিল, সম্ভব হলে উলামায়ে নদওয়া থেকে সত্যায়ন করে দিন। আফসোস এ চিঠিটি হারিয়ে গেছে। নতুবা এ চিঠিটিও দেখার মতো ছিল যে, হযরত তার একজন ভক্তের কাছে এ ধরনের লেখা কোনো শব্দে লেখেন।
২৮ জুনের চিঠি এভাবে শুরু হয়—
ম. الحيلة الناجزة এসেছে। আজ আমার কাছে রেখে কাল ইনশাআল্লাহ আমার চিঠির সঙ্গে লখনৌ পাঠিয়ে দেব।
আ. এভাবে গুরুত্ব প্রদানের জন্য আল্লাহ তাআলা আপনাকে উত্তম বিনিময় দান করুন।
ম. নদওয়ায় দুজন অনন্য—সাধারণ আলেম আছেন। একজন দারুল উলূমের সদর মাওলানা মুফতী হায়দার হাসান খান টুংকি। আরেকজন ফকীহে আওয়াল মাওলানা মুহাম্মদ শিবলী। খুব সম্ভব তারা সত্যায়ন করেই দেবেন, সঙ্গে অন্যান্য শিক্ষকগণও দস্তখত করে দেবেন।
আ. কাউকে জোরাজুরি করবেন না। সত্যায়নের ভাবনা এসেছে জনসাধারণের আস্বস্তির জন্য। নতুবা মানুষকে হুকুম জানিয়ে দেওয়ার যে মূল উদ্দেশ্য তা সত্যায়নের উপর নির্ভর নয়।
ম. তবে মাদরাসা ছুটি চলছে। শিক্ষকরাও বাড়ি চলে গেছেন। এ জন্য সময় লাগবে।
আ. এতে সমস্যা নেই।
ম. এমন খেদমত নিজের জন্য গৌরব ও সৌভাগ্য মনে করি। এ জন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি যেকোনো ধরনের লৌকিকতা ছাড়াই আমাকে এ খেদমতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আ. এ বিষয়ে কল্যাণের দুআ করছি।
ম. কিতাব ভাসাভাসা দেখেছি। মাসআলার ব্যাপারে আমার মতো সাধারণ মানুষ মতামত কীভাবে দেবে। কিন্তু এতে কোনো সন্দেহ নেই, কিতাব সময়ের বড় গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনে রচিত হয়েছে। অনুসন্ধান ও খোঁজাখুঁজির বেলায় যে প্রাণান্তকর পরিশ্রম হয়েছে, তার কথা আর কী বলব। আল্লাহই আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। দ্বীনি প্রয়োজনের প্রতিটি ক্ষেত্র, প্রতিটি দিক আপনার দৃষ্টিতে থাকে।
আ. নজর যাওয়া তো আল্লাহর বিশেষ দান। কিন্তু কাজ পূর্ণ করা আমার সাধ্যের বাইরে ছিল। একদল আমাকে সহযোগিতা করেছে। যাদের নাম এ পুস্তিকার বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন শিরোনামে উল্লেখ হয়েছে।
আটষট্টি
চিঠির মূল বিষয় তো এ সময়ে তাফসীর ও তরজমাই ছিল।
চিঠির বাকি অংশও এ সংশ্লিষ্টই।
ম. প্রথম পারার পাণ্ডুলিপির প্রতিলিপি সুস্পষ্ট অক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে এসেছে। এখন আপনার খেদমতে পাঠাচ্ছি।
আ. হস্তাক্ষর অনেক সুন্দর। একটু দেখলেই পুরো দেখার আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
ম. আমার প্রকৃত আনন্দ তো এটাই ছিল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখে দেবেন।
আ. যেভাবেই হোক এই পারা অক্ষরে অক্ষরে দেখব। এরপর আর দেখার সাহস হয় না।
ম. আপনি দেখলে আমার আশ্বস্তি হয় এজন্য যে যেসব সূক্ষ্ম বিষয়ে আপনার দৃষ্টি যায় সেসব বিষয় অন্য হযরতদের কল্পনায়ও আসে না।
بسیار خوباں دیدم تو چیزے دیگری
বহু গুণধর দেখেছি কিন্তু তুমি অন্য তুমি অনন্য।
আ. এ ধারণা তো কেবলই মহব্বতপ্রসূত। যাতে খুব বেশি বাস্তবতা থাকা আবশ্যক নয়। কিন্তু মহব্বতের কারণে কখনো কখনো কোনো কাজের জিনিস লাভ হয়ে যায়।
ম. কিন্তু আপনার ব্যস্ততা ও প্রচুর কাজের কথাও মনে আছে। এজন্য আমার এ নিবেদনের ব্যাপারে কখনোই জোর—জবরদস্তি নেই।
আ. এখন নিজের তাফসীর সম্পাদনা করছি, যা শেষ হওয়ার পর্যায়ে। ইনশাআল্লাহ রবিউস সানীর শুরু থেকে এটা দেখা শুরু করব।
ম. ব্যাস যতটুকু যতদিনে সহজে বিনা কষ্টে দেখা সম্ভব হয় তাই যথেষ্ট মনে করব। তাতেই সন্তুষ্ট থাকব। আপনার সুউচ্চ মন্তব্যের জন্য সাদা কাগজ আলাদা খামে দিয়ে দিচ্ছি।
আ. এটা আপনার মেহেরবানী। কিন্তু আমার মতে এর প্রয়োজন অবশ্যই আছে যে কোনো মুহাক্কিক শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পূর্ণ কোরআনের তরজমা দেখে দেবেন। ভাসাভাসা দৃষ্টিতে দেখে তা মনে হয়েছে।
ম. এ কথাও নিবেদন করছি, প্রাথমিক পর্যায়ে মাওলানার দেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।
আ. আমি এখন কাউকে এর বাতাসও লাগতে দেব না। কখনো আপনার অনুমতি হলে দেখানো হবে।
ম. যেসব বিষয়ের প্রতি আমি লক্ষ্য রেখেছি তা নিবেদন করছি—
এক. যতদূর শরঈ মাসায়েল সংশিষ্ট, চাই সেটা আকীদা হোক অথবা আমল ও আহকাম, সে ক্ষেত্রে আমি পুরোপুরি আপনারই অনুসরণ করেছি এবং বয়ানুল কোরআনের একেকটি লাইনের সঙ্গে মিলিয়েছি। বরং তরজমার বেলায় তো একাধিক অংশ হুবহু এখান থেকে নকল করেছি। এক্ষেত্রেও যদি কোথাও ভুলে বা অনিচ্ছায় এ নিয়ম লঙ্ঘিত হয়ে থাকে তার ব্যাপারে সতর্ক করলেও ইনশাআল্লাহ ঠিক করে নেব। এ হিসেবেই আমার তরজমাকে আহলে সুন্নতের তরজমার মুখপাত্র বলতে পারব।
দুই. ভাষা ও ব্যাকরণের সর্বক্ষেত্রে এবং অন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে আপনারই অনুসরণ করেছি। কোথাও কোথাও শাইখুল হিন্দ অথবা অন্য আকাবিরের সঙ্গে একমত পোষণ করেছি। সেখানেও আপনার অবলম্বন করা মত উল্লেখ করে দিয়েছি। যেমন بقرة শব্দের তরজমার বেলায় অথবা ملة إبراهيم حنيفا এর তরকীবের বেলায়।
আ. বেশ উপযুক্ত পদ্ধতি। এজন্য আমি এ দিকে বেশি মনোযোগ দেব না। কারণ, আপনার উপর আস্থা আছে।
ম. শুধু এক ক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত অধ্যয়নের উপর নির্ভর করতে হয়েছে। এটা করতে হয়েছে এজন্য যে, এ বিষয়ে আমার সামনে কোনো অবলম্বন নেই। সে ক্ষেত্রটি হলো ইতিহাস, ভূগোল ও আকায়েদ। কিতাবটি তো মূলত ইহুদী, নাসারা ও মুলহিদদের সামনে যাওয়া উদ্দেশ্য। তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য বিষয় দ্বারা দলীল পেশ না করা পর্যন্ত কিতাবের প্রভাব পড়বে না।
আ. একদম ঠিক। এমনই করা উচিত ছিল। বিস্তারিত পড়ার সময় এ বিষয় রক্ষার বিষয়টি সামনে রাখব। কোথাও সন্দেহ হলে মতামত প্রকাশ করব।
ম. বিরুদ্ধাবাদীদের শুধু একটি আপত্তির উত্তর আমি এখনো পাইনি। অনুসন্ধান অব্যাহত আছে। আজকালের ইহুদীরা বলে, উযায়ের আ. এর ابن الله হওয়ার কথা আমরা বলি না। এটা আমাদের তাওহীদে বিশ্বাসী হওয়ার উপর অপবাদ। এর উত্তর আমাকে তাদের কিতাব থেকেই খুঁজে বের করতে হবে।
আ. আল্লাহ বের করে দেবেন। জানি না তাফসীরে হক্কানী সামনে আছে কি না। সেখানে এসব বিষয় অনেক এসেছে। কোথাও না পাওয়া গেলে সহজ উত্তর হলো এই, কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময় ইহুদীদের কোনো দল এমন থেকে থাকবে, যার বিপরীত দলীল কারও কাছে নেই।
হযরতের এ জবাব তখনও তো আমার মনে ধরেনি। এখনো এ জবাব যথেষ্ট মনে করি না। আমার তাফসীরে আমি আরজ করেছি ابن الله এর অর্থ ولد الله অর্থের চেয়ে ভিন্ন। কোরআনের পরিভাষায় ابن ও ولد প্রতিশব্দ নয়। ولد দিয়ে উদ্দেশ্য হলো ঔরসজাত সন্তান। বিপরীতে ابن ব্যাপক অর্থ ধারণ করে। প্রত্যেক প্রিয় ও স্নেহের মানুষকেই ابن বলা হয়। যা কোরআনের এ আয়াতে আছে, نَحْنُ اَبْنٰٓؤُا اللهِ وَاَحِبَّآؤُهٗ। সুস্পষ্ট বুঝা যায় এখানে ابن দ্বারা ঔরসজাত সন্তান উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হলো প্রিয় ও স্নেহভাজন। খ্রিষ্টানদের শিরক দ্বিগুণ ছিল। তারা হযরত ঈসা আ. কে খোদার ولد ও ابن উভয়ই মনে করত। ইহুদীদের শিরক সে পর্যন্ত গড়ায়নি। তারা উযায়ের আ. এর প্রতিটি শব্দকে আল্লাহর বাণী সাব্যস্ত করতে লাগল। তাওরাত হারানোর পর উযায়ের আ. এর লেখা তাদের হাতে আসার পর পরবর্তী পথপ্রদর্শক ও রাসূলের হেদায়াত থেকে নিজেদেরকে অমুখাপেক্ষী মনে করতে লাগল। উযায়ের আ. কে ابن الله বলার অর্থ এটাই।
১৪ জুলাইয়ের চিঠি উপরোক্ত বিষয়ের সঙ্গে পুরোপুরি সংশ্লিষ্ট। তাই একসঙ্গেই পড়তে হয়।
ম. পূর্ণ পারা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখবেন জানতে পেরে খুশিতে বাগবাগ। আমি আনুগত্য অনুকরণ ইত্যাদির দাবি তো করি না। তবে কোনো ধরনের লৌকিকতা ছাড়া এটুকু নিবেদন করছি, আপনার পক্ষ থেকে সমালোচনা ও ভুল ধরিয়ে দেওয়া আমার মনে অনেক প্রিয় এবং আমার দৃষ্টিতে অনেক প্রভাবক অন্যের সমর্থন ও সঠিক বলার চেয়ে।
আ. এ হলো মহব্বতের বহিঃপ্রকাশ। যেমন নাকি রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের চেয়ে প্রিয়। যেমন মা—বাবার কাছে নিজ সন্তানের পেশাব অন্যের গোলাপ ও কেউড়া জলের চেয়ে প্রিয়।
ম. সত্য বলছি আপনার যেসব এরশাদে আমার আশ্বস্তি হয় না সেসব শুনে পড়েও আনন্দ পাই।
আ. শিশুর যে চাওয়া পূর্ণ করা হয় না সেসব চাওয়া শুনেও আনন্দ লাগে। এসবই অপরাধী মহব্বতের প্রভাব।
ম. দ্রুত ফেরত পাঠানোর কথা ভেবে আপনার মূল্যবান সময়ে কিছুতেই ভার চাপিয়ে দেবেন না। সহজে যখন সম্ভব হবে তখনই ফেরত দিন।
আ. অপেক্ষা তো এরই ছিল। এ ব্যাপারে নিরাশা ছিল তাই এর ধারে কাছে যাইনি।
ম. আপনি লিখেছেন, কোরআনের ব্যাপারে কোনো মুহাক্কিক থেকে যেন সহযোগিতা নেই, আমি তো এটা খোদার কাছে চাচ্ছি। কিন্তু আপনি ছাড়া অন্য কাউকে আনব কোত্থেকে?
عالم ميں تم سے لاکھ سہی تم مگر کہاں
জগতে তোমার নজির থাকতে পারে বহু কিন্তু সেই বহু তো আর তুমি নও।
আপনার মধ্যে তিন জিনিসের যে সমাহার ঘটেছে তা অন্য কারও মধ্যে পাওয়া যায় না। অর্থাৎ এক দিকে দ্বীনদারী, দ্বিতীয়ত গভীর দৃষ্টি, তৃতীয়ত সময়ের প্রয়োজনীয় বিষয়াবলীর প্রতি খেয়াল রাখা। অকৃত্রিম অনুগ্রহকারীদের মধ্যে আছেন, মাওলানা মানাযির আহসান গিলানী, মাওলানা সাইয়্যেদ সুলাইমান নদভী। আপনার মাপকাঠি অনুযায়ী তাদেরকে মুহাক্কিক বলা খুব সম্ভব ঠিক নয়। তাহলে কার থেকে সহযোগিতা নেব?
আ. এসব কথা মেনে নিলে এক্ষেত্রে দুটি সুরতই সামনে আছে, হয়তো আপনি যাদেরকে মুহাক্কিক মনে করেন তাদেরকে নির্বাচন করে নিন। অন্যের দৃষ্টিতে মুহাক্কিক না হলেও। কারণ, সব মতামত গ্রহণ করা তো জরুরী নয়। অথবা আপনি এখানে এসে থাকুন। যে সংশয় দেখা দেবে সঙ্গে সঙ্গে নিরসন হতে থাকবে। তাহলে এর জন্য আলাদা সময় ব্যয় না করে এ খেদমত আঞ্জাম দিতে পারব।
ম. মাওলানা… সাহেবের কথাও একটু একটু মনের মধ্যে আসে। তবে তার সঙ্গে নামকাওয়াস্তে সম্পর্ক।
আ. এর সমাধান তো সহজ ছিল। তার অনুগ্রহের শিকলে আপনার আটকে যাওয়া আমার কাছে ভালো লাগছে না। তাছাড়া তার মধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা নেই।
ম. তাফসীরে হক্কানীতে নিঃসন্দেহে একটা পর্যায় পর্যন্ত আমার কাজের জিনিস পেয়ে যাই। কিন্তু আমার প্রয়োজন এর চেয়ে অনেক বেশি কিছু।
আ. ঠিক আছে। যতটুকুই পাওয়া যায়।
ম. বর্তমান মুলহিদরা যুক্তি ও দর্শনের পুরোনো মোর্চা তো অনেকটা ছেড়ে দিয়েছে। এখন তাদের মূল আক্রমণ ইতিহাস ইত্যাদি বর্ণনা—নির্ভর জ্ঞানের ক্ষেত্রে হচ্ছে। যেমন,
كُتِبَ عَلَیْكُمُ الصِّیَامُ کَمَا كُتِبَ عَلَی الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ
এসে চট করে বলে বসে, প্রাচীন ধর্মগুলোতে তো রোযা ফরজ ছিল না। এখন এর যৌক্তিক জবাবের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু ইহুদী, অগ্নিপূজারী ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থের উদ্ধৃতি বের করে দেখিয়ে দেওয়া।
আ. নিঃসন্দেহে এটাই করণীয়। আমার মতে আপনি শুধু আপত্তিকারীদের জবাব যোগ করার দায়িত্ব গ্রহণ করুন। চাই সে আপত্তি যৌক্তিক মূলনীতির উপর হোক কিংবা উদ্ধৃতি—নির্ভর মূলনীতির উপর। বাকি আমি নগণ্যের এবং মাওলানার তরজমা ও তাফসীর হুবহু নকল করে দিন। ইচ্ছা হলে ভাষা সম্পাদনা করে নিতে পারেন। তাহলে আপনার কাজ খুব সম্ভব সহজ হয়ে যাবে এবং যে দেখে দিবে তার কাজও। তখন আপনার স্থান পরিবর্তনেরও প্রয়োজন নেই, আপনার কষ্টও কম হবে।
ম. এ ধারাবাহিকতায় ফেরআউনের ঘটনায় বলে, মিশরের ইতিহাসে এর প্রমাণ পাওয়া যায় না। শুধু ইসরায়েলের ইতিহাসে উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রমাণের জন্য এটা যথেষ্ট নয়। হতে পারে ইসরায়েলীরা নিজ শত্রুদের বদনাম করার জন্য এ ঘটনা বানিয়েছে। এখন এর জন্য প্রয়োজন হলো প্রাচীন মিশরের ইতিহাসে গভীর দৃষ্টি দেওয়া। প্রাচীন যেসব বইপত্র বর্তমানে পাওয়া গেছে সেসব সম্পর্কে অবগত হওয়া।
আ. বাস্তবে এরও অনেক প্রয়োজন। এই কাজের মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত উম্মত আপনার অনুগ্রহ লাভে ধন্য হবে। এ চেষ্টা আপনার জন্য জান্নাতে যাওয়ার কারণ হবে।