হাকীমুল উম্মত : স্মৃতি ও অভিব্যক্তি
স্মৃতিকথা
পয়ষট্টি
অসুস্থতা এত দ্রুত ও সহজে শেষ হওয়ার ছিল না। এখনো হযরতের পক্ষ থেকে আরও সান্ত্বনাপত্র ভাগ্যে ছিল। সে রোগী বড় বরকতময় যার এমন শুশ্রূষাকারী জোটে।
صحتیں لاکھوں ہوں اس بیمارئ غم پر نثار
جس میں آئے بارہا ان کی عیادت کے مزے
এমন অসুস্থতার প্রতি লাখো সুস্থতা কোরবান হোক যাতে বারংবার লাভ হয় সান্ত্বনার শুভাশিস।
সৌভাগ্যবান সে রোগী যে এমন ডাক্তারের কাছে যেতে পারে।
خوش طبيبے ست بيا تا ہمہ بيمار شويم
দারুণ চিকিৎসক, চলো সকলে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার মজা লুটি।
১৪ এপ্রিল নিম্নোক্ত চিঠি লিখি—
ম. শরীর ভালো হয়ে গেছে মনে করে কাল লখনৌ থেকে দরিয়াবাদ এসে পড়েছি।
আ. আমার মত ছিল দ্রুত ফিরে না আসা। কিন্তু আমি দরিয়াবাদে কী করে খবর দিই।
ম. ফেরার পর ঘটনা ঘটল এর বিপরীত। রাতে অনেক কষ্টে ঘুম এসেছে, অস্থিরতাও ছিল। মাঝে মাঝে হৃদস্পন্দন এতটাই বেড়ে যাচ্ছিল যেন সারা শরীর কাঁপছে। বেহুঁশ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সব সময় থাকে। দিনের বেলা কয়েক বারই মনে হয় হৃদস্পন্দন এখন থামতে চায়।
আ. ঘাবড়ানোর কিছু নেই। এর দরুন বেশির চেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং খুব সহজেই দূর হয়ে যায়। ইনশাআল্লাহ খুব দ্রুত এ কষ্ট দূর হয়ে যাবে।
ম. নামাযে মনোযোগ ছিলই—বা কবে, এখন তো একেবারে বিদায় নিয়েছে।
আ. এ অনুপস্থিতি ও বিক্ষিপ্ততা সেই হুজুরি থেকেও বেশি উপকারী। আসল হলো মুজাহাদার পথ। এটা হলো মুজাহাদার একটি অবস্থা। যে হুজুরিকে এ অবস্থার উপর প্রাধান্য দেওয়া হয় তার মধ্যে নফসের চাহিদা মিশ্রিত থাকে। আল্লাহ তাআলা বান্দাকে যা দেন তা সবচেয়ে উপকারী ও সবচেয়ে উপযুক্ত।
ম. কোনো বড় সূরা তো পড়তেই পারি না, বিশেষত এশার নামাযে। বিষয়টা এমন পর্যায়ে গড়িয়েছে যে বারবার নিয়ত ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে। আলহামদুলিল্লাহ কখনো এমন করে নিয়ত ছাড়তে হয়নি।
আ. এটা শুনে হয়তো আপনি সান্ত্বনা পাবেন, আজকাল শারীরিক অসুস্থতার কারণে আমার মামুলাতেরও একই হালাত। তবে আমি খুশি, ডাক্তার বিস্বাদ ওষুধ নির্ধারণ করলেও এতেই কল্যাণ নিহীত।
ম. আল্লাহ জানেন পরিণতি কী হবে।
আ. একদমই সেরে যাবে। আর তা খুব দ্রুত প্রকাশ পাবে।
ম. আজ আবার লখনৌ ফিরে যাচ্ছি। আজ বেহেশতী জেওর দেখে তাবীজ নিজে লিখে পরে নিয়েছি। তবে জনাবের হাতের বরকতই অন্যরকম।
আ. খামে ভরে দিয়েছি, আল্লাহ তাআলা উপকারী করুন।
ম. এই তাবীজ ছাড়াও দুআ অথবা যে তদবীর মনে পড়ে তার প্রতি খুবই মুখাপেক্ষী।
আ. এক. অন্তর প্রফুল্ল ও শক্তিশালী রাখে এমন ওষুধের ব্যবহার করুন।
দুই. কিতাবুর রজা (আল্লাহর প্রতি আশা ও প্রত্যাশা সৃষ্টি করে এমন সব হাদীস রেওয়ায়াত) অধ্যয়ন করুন, না বরং মনোযোগ দিয়ে শুনুন। সেটা ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন কিংবা কিমিয়ায়ে সাআদাত অথবা গাজালীর আরবাঈন থেকে হতে পারে।
তিন. অন্তরঙ্গতা আছে এমন কাউকে সদা সঙ্গে রাখুন। যে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে আপনাকে মন খুশি করা কথায় মগ্ন রাখতে পারে।
চার. কখনো ভালো লাগলে মনের মাঝে চাঁদের কল্পনা করুন। ভাবুন, অন্তরে হালকা বৃষ্টি হচ্ছে।
পাঁচ. যখন সম্ভব হয় তখন দুরূদ শরীফ পড়ে হার্টের উপর ফঁু দেওয়া।
এসব তদবীর মহৌষধ। কোনো খাদেমকে বললে সে তৃতীয় চতুর্থ দিনে আমাকে অবস্থা জানাবে। আমি ইনশাআল্লাহ নিয়মিত দুআ করতে থাকব।
من غم تو مى خورم توغم مخور
আমি তোমার দুশ্চিন্তা নিয়ে ভাবছি তুমি দুশ্চিন্তা করো না।
ম. কখনো কখনো হতাশা ছেয়ে যায়।
আ. এর মধ্যেও হিকমত আছে, যেন আশাবাদিতার নেয়ামতের কদর হয়।
এ অকর্মণ্য অনুগ্রহপ্রাপ্তের প্রতি হযরতের যে অসাধারণ স্নেহ ছিল তা উপরের পৃষ্ঠাগুলোতে বারবার এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে স্পষ্ট হয়েছে। এর স্বাভাবিক চাওয়া এটাই ছিল, হযরতের দিল ‘আমি ভালো আছি’ সংবাদবাহী চিঠির অপেক্ষায় থাকবে। ২৪, ২৫ এপ্রিলে নিজের ভালো থাকার কথা এবং অন্যান্য অসুস্থতার আলোচনা এক কার্ডে উল্লেখ করি। এর উত্তরে নিম্নের আশিসপত্র পৌঁছে—
‘কয়েকদিন ধরে ভালো সংবাদের অধীর অপেক্ষায় ছিলাম। মাওলানা হুসাইন আহমদ সাহেব ওয়াকফ বিল সংশোধনের কাজে দেওবন্দ ও সাহারানপুরের অন্যান্য হযরতসহ এখানে তাশরীফ এনেছিলেন। এমনকি তাঁকেও আপনার চিঠি আসার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু বিস্তারিত অবস্থা জানতে পারিনি। আলহামদুলিল্লাহ আজ সুস্থতার সুসংবাদ শুনেছি। আল্লাহ তাআলা অবশিষ্ট অসুস্থতা ও দুর্বলতাও দূর করে দিন। আপনার ও আপনার স্ত্রীর উপর যে প্রভাব পড়েছে তা মহব্বতপ্রসূত।
আল্লাহ তাআলা উভয়কে উত্তম প্রতিদান দিন। আসলেই আমার কাছে কিছু নেই। কিন্তু أنا عند ظن عبدي بي এর ঝরনাধারা থেকে শুভার্থীদের কাছে কিছু পৌঁছে থাকে।
মাওলানার শুভাগমনকালে এবং বিশেষ কারণে আপনার কথা অনেক মনে পড়েছে। তা হলো, আমাদের একত্রিত হওয়া, পারস্পরিক যোগাযোগ, হাসিখুশি সম্পর্ক, মর্যাদা ও পদবির প্রতি লক্ষ রাখতে দেখে আপনার বিশেষ রকমের আনন্দ হয়। যেমনটা আমি জানি।’
এই শেষ লাইনগুলো যে ভদ্রতার বহিঃপ্রকাশ তা শুধু এমন কলব ও কলম থেকে প্রকাশিত হওয়া সম্ভব যে কলব ও কলম ভদ্রতার উৎস।
প্রাজ্ঞজনের একেক কাজ কত প্রজ্ঞার সমষ্টি। অসুস্থতার কারণে অনেক অনেক হিকমত প্রত্যক্ষ হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, অসুস্থতা যেমনিভাবে স্বপ্নের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল, শেষও হয়েছিল স্বপ্নের মধ্য দিয়ে। পহেলা মে’র লেখা চিঠি ওইসব অবস্থার ব্যাখ্যাতা ও প্রতিনিধি।
ম. কঠিন রোগ তো আলহামদুলিল্লাহ আপনার তাবীজের বরকতে তখনই যাওয়া শুরু করেছিল। কিন্তু শরীর একেবারে সুস্থ হয়নি। কখনো মাথা চক্কর দিত। কখনো হৃদকম্পন। এ অবস্থা পরশু সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিল। কাম—কাজ একেবারে বন্ধ। এশার পর নিজের সুস্থতার জন্য একটু কাকুতিমিনতি করে দুআ করি। দুআ তো আগেও অনেকবার করেছি। কিন্তু এখন কিছুটা মন লেগে গিয়েছিল। দুআয় এ কথা নিবেদন করছিলাম, ভালো—মন্দ যে খেদমতই তোমার দ্বীনের জন্য হচ্ছে সেজন্য সুস্থতা ও আরোগ্য নসীব করো। দুআ করার সময় মনে হলো, দেহের পশম দাঁড়িয়ে গেছে। কোরআনে কারীমে বর্ণিত تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُودُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ এর অনুভূতি জেগে উঠল। এটা আমার অনেকবারের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা যে এগুলো দুআ কবুলের আলামত। ঘুমের মধ্যে দেখি, গোঁয়ার প্রকৃতির কিছু হিন্দু মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করছে, বিশেষ করে আমার ওপর। অন্যরা তো উধাও হয়ে গেল। এক আক্রমণকারী আমার দিকে অগ্রসর হলো। আমি নিরস্ত্র। তবে একটুও ভীত ও পেরেশান নই। তবে তাকে মোকাবেলার পাশাপাশি দুআয় মশগুল হয়ে যাই, হে মাবুদ তুমি এ কাফেরকে আমার ওপর বিজয়ী করে নিজ দ্বীনের অপমান এবং নিজ অনুসারীদের পরাজয়ের ব্যবস্থা করে দেবে? এ দুআ করতেই সে মুশরিক এমনভাবে উধাও হয়ে যায় যেন লবণ গলে গেছে অথবা পানি বাষ্প হয়ে উড়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে যায়। সঙ্গে এ ব্যাখ্যাও দৃঢ়ভাবে মাথায় আসে যে, রোগ বিদায় নিল। দ্বীনের খেদমতের জন্য আমার অবকাশ লাভ হলো। সুতরাং সকাল সকালই আমি ঘরে বলে দিই, এখন ইনশাআল্লাহ একেবারে সুস্থ হয়ে যাব। আলহামদুলিল্লাহ তখন থেকে অর্থাৎ কাল সকাল থেকে আজ এ সময় পর্যন্ত একেবারে সুস্থ। শরীর আগের মতো সতেজ ও প্রফুল্ল। আমার জন্য এ ঘটনা বড় অদ্ভুত ও বিরল। এজন্য জনাবের খেদমতে আগাগোড়া বয়ান করছি।
আ. আসলেই দেখতে অদ্ভুত। আর আল্লাহ ও বান্দার সম্পর্কের দিকে লক্ষ করলে অদ্ভুত নয়। বরং এমন না হওয়া অদ্ভুত। যার কারণ আমাদের ত্রুটি। ওদিক থেকে কোনো কমতি নেই।
آنچہ ہست از قامت کوتاہ ونامو زدن مااست
ورنہ تشریف تو بربالائے کس کوتاہ نیست
যা কিছু কমতি ও ঘাটতি সবই মোদের নতুবা তোমার আশিসে তো নেই কোনো কার্পণ্য।
আপনাকে মুবারকবাদ দিচ্ছি। একে তো শারীরিক সুস্থতা। দ্বিতীয়ত আত্মিক সুস্থতা যে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে এক বিশেষ সম্পর্ক লাভ হয়েছে।
মজার ব্যাপার! স্বপ্ন থেকেই রোগ শুরু হয়েছিল স্বপ্নতেই শেষ হয়েছে।
درد از یادست ودرماں نیز ہم
এক স্বপ্ন দিয়ে ব্যথা শুরু, উপশমও আরেক স্বপ্ন।
অবগতি : আমি আন্—নাজম পাঠাতে না করে দিয়েছি। এখন আসে না। মন বিগড়ে গেছে।
ম. ভাই সাহেব সাহারানপুর থেকে সীতাপুর বদলি হয়ে গেছেন। বাড়ির আরও কাছে এসেছেন। কিন্তু থানাভবন থেকে যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। ব্যস এরই জন্য আফসোস। আমার জন্যও এ পর্যন্ত থানাভবন হাজিরী যতটা সহজ ছিল তাও কিছুটা কমে গেছে।
আ. আমারও স্বাভাবিকভাবেই আফসোস হচ্ছে। আমি কি আমার স্ত্রীও আফসোস করছেন। অন্যভাবে বললে, আমার স্ত্রীর সঙ্গেও আপনার স্ত্রীর দেখা করা কঠিন হয়ে গেল। খোদ ডেপুটি সাহেবের আখলাকের কথাও মনে পড়ছে। আন্তরিকতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। এ পরিমাণ লক্ষ রাখতেন যে খাবার সঙ্গে নিয়ে আসতেন। তবে তাঁর আরাম হবে জেনে যৌক্তিক কারণে খুশি লেগেছে। এক তো বাড়ির কাছে যাওয়ার দরুন। দ্বিতীয়ত সীতাপুরের আবহাওয়া সাহারানপুরের তুলনায় বেশি উপযোগী হবে। অসুস্থতা কমে যাবে। বাকি তাঁর সঙ্গে যে আত্মিক সম্পর্ক তাতে কাছে ও দূরের কোনো পার্থক্য নেই। ওয়াসসালাম।
চিঠির প্রথম অংশ প্রজ্ঞাপূর্ণ হওয়া তো একেবারেই স্পষ্ট। হাকীমুল উম্মতের একেবারে উপযুক্ত। কিন্তু দ্বিতীয় অংশ যা একটি ব্যক্তিগত ও ঘরোয়া বিষয়—সংশ্লিষ্ট তাও ভদ্রোচিত হওয়ার বেলায় নিজেই নিজের উপমা। হাকীমুল উম্মতের কাছ থেকে অন্যরা যিকির, শোগল এর মতো বুযুর্গির উপাদান যাই শিখুক, এই অভাজনের তো হযরতের দৈনন্দিন জীবন থেকে বড় শিক্ষা লাভ হয়েছে মানবতা, মনুষ্যত্ব, সুন্দর জীবন ও পূর্ণ আখলাকের। আখেরাত তো লাভ হয়ই। পার্থিব জীবনও আশরাফ পন্থা অবলম্বনের দ্বারা উত্তম ও সবচেয়ে সুখময় হতে পারে।
ছেষট্টি
চিঠি সমাপ্ত হয়েছে। কিন্তু চিঠির টীকা রয়ে গেছে। টীকা খোদ মাওলানার নয়। তা সাচ্চা আশেক, একনিষ্ঠ মুরীদ খাজা আজীজুল হাসান গৌরি মাজযূবের কলমে লেখা টীকা। জযবায়ে ইশকের দিক দিয়ে নিজ মুরশিদের মাঝেই বিলুপ্ত এবং ‘আমি হয়ে গেছি তুমি, তুমি হয়ে গেছ আমি’ এর রূপ।
‘এ সময় উপস্থিত থাকা নগণ্য আজীজুল হাসান মাসনূন সালামের পর সুস্থতার দরুণ অন্তর থেকে মুবারকবাদ আরজ করছি। আল্লাহ তাআলা সুস্থতা ও নিরাপত্তার সঙ্গে শান্তিতে সসম্মানে রাখুন। আমীন। দেওয়ানে হাফেজ দেখে যে শের হযরত আপনাকে চিঠির অপর পিঠে লিখেছিলেন তার প্রথম পঙ্ক্তি হযরতের মনে পড়ছিল না। আমি আবার লিখছি—
ہرچہ ہست از قامت نا سازبے اندام ماست
‘হযরত আপনাকে অনেক স্মরণ করেন এবং আপনার ভালো আলোচনা করেন।’
হৃদরোগ তো আল্লাহ আল্লাহ করে শেষ হয়ে গেছে। অসুস্থতায় মসনবীর এ পঙ্ক্তি গুণগুণ করতে থাকতাম—
نیست بیماری چو بیمارئ دل
অন্তরের অসুস্থতার মতো আর অসুস্থতা নেই।
তবে কোনো না কোনো রোগ লেগেই ছিল। কখনো সর্দি, কখনো জ্বর ইত্যাদি। অনেক ইচ্ছা হলো, একবার একদিনের জন্য হলেও থানাভবনে হাজিরী দিয়ে আসার। কোনো সুযোগ হয়ে উঠল না। ৫ অথবা ৬ মে আফসোসে পূর্ণ এক কার্ড লিখি। উত্তরে নিয়মমাফিক সান্ত্বনাপত্র এসে পৌঁছল।
‘আমার হযরত মুর্শিদ থেকে শুনেছি, কখনো দয়ার প্রদর্শন হয় রাগের মতো করে। এর একটি বাস্তবতা হলো আপনার অসুস্থতা, এটা নৈকট্য লাভের উপায়। এটাও হযরত থেকে শুনেছি, যেমনিভাবে আমল নৈকট্য লাভের পথ তেমনিভাবে অসুস্থতাও নৈকট্য লাভের পথ। দাসত্ব ও নিজেকে সঁপে দেওয়ার মানে হলো, যে বিশেষ সময় শুরু করেছেন তাতে তাড়াহুড়া একেবারে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন এবং চিরসত্য আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিন। তাঁর হেকমতে যেটা কল্যাণকর হবে তাতেই ব্যবহার করবেন। বাকি দুআ ও তদবীরে মশগুল থাকুন। আমিও দুআ করছি। সে হিসেবে সাক্ষাৎও আল্লাহর হাওয়ালা করুন।
کہ آنچہ ساقئ ما ریخت عین الطاف ست
আমাকে যারা শুষ্ক স্বভাবের বলে তারা ওই ব্যক্তির মতোই ক্ষমাযোগ্য মাযুর, যে সাঁতারে রত ব্যক্তিকে শুষ্ক দেহ বলে। অর্থাৎ তুলনামূলকভাবে এমনই। মূলত যেই তাদের অনুসরণ করবে না সেই শুষ্ক ও বদমেজাজের।
ঘরওয়ালী সত্য বলেছেন, তবে যত দেরিতে মাস্তুরাত পরস্পরে মিলিত হবে ততই আনন্দ পূর্ণতা পাবে। এটাও হিকমতের পর্যায়ে পড়ে। পুনরায় সুস্থতার দুআ করে এখন ইতি টানছি।’
تفويض وتسليم সমর্পণ ও মান্যতার ব্যাপারটি অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে গেলে এ দুনিয়াই জান্নাতের নমুনা হতে পারে। দাসত্বের চাওয়াও এটাই। মুহাম্মদ আলী জাওহার খুব সুন্দর বলেছেন—
ہر رنگ میں راضی برضا ہو تو مزا دیکھ
دُنیا ہی میں بیٹھے ہوئے جنت کی فضا دیکھ
যেকোনো পরিস্থিতিতে রাজি—খুশি থেকে দেখো তার মজা কত।
মর্তলোকে থেকেই স্বর্গলোকের মজা লুট।
আলহামদুলিল্লাহ স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে। তবে ধীরে ধীরে। সাহস ও সাধ্য অনুযায়ী শক্তি এখনো ফেরেনি। যাই হোক, এতটুকু হয়েছে বন্ধ হয়ে যাওয়া কাজের ধারা নতুন করে শুরু হয়েছে। থানাভবন হাজিরী দেওয়ার আকাক্সক্ষা রয়েই যায়।
২৪ মের চিঠি পুরোটাই পড়ার মতো।
ম. এখন আলহামদুলিল্লাহ কয়েকদিন ধরে ভালো আছি।
আ. আলহামদুলিল্লাহ।
ম. কিছু কাজও শুরু করেছি।
আ. বেশি করবেন না। আল্লাহ না করুন, যদি আবার কোনো সমস্যা দেখা দেয়।
ম. যতটুকু কাজ করতে ইচ্ছে করে তার অর্ধেকও এখন করতে পারি না।
আ. মনের চাওয়া অনুযায়ী কাজ করবেন না। আকলের ফতোয়া অনুযায়ী কাজ করুন।
ম. দিনে ঘুমানোর কোনো নিয়ম ছিল না। এখন ঘুমানো আবশ্যক হয়ে গেছে। ডাক্তারও বলেছেন। অভিজ্ঞতায়ও উপকারী মনে হয়।
আ. খুবই দরকার।
ম. থানাভবন হাজিরীর কথা কী বলব। এর মধ্যে কত চেষ্টা করেছি। দৃঢ় ইচ্ছা ছিল যে, ভাই সাহেব যেদিন সাহারানপুর যাবেন তার দুদিন আগে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে পৌঁছে যাব। এক দিন এক রাতের জন্য থানাভবনে হাজির হব। আপনাকে ব্যবস্থাপনার কষ্ট থেকে বাঁচিয়ে দেব বলে ভেবেছিলাম। রাতে স্ত্রীকে নিয়ে খাজা সাহেব অথবা জলীল আহমদ খান সাহেবের ওখানে এসে যাব। উভয় হযরতই নিঃসন্দেহে বিষয়টি মেনে নেবেন।
আ. আমি সেসব হযরতের মতো খুশি হব, সে দাবি করছি না। খেদমত নিলে আমার আনন্দও কম হতো না। খেদমত না নিলে আফসোসেরও কমতি হতো না।
ম. এসব পরিকল্পনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ঠিক আগমুহূর্তে তীব্র জ্বর দেখা দেয়। সব পরিকল্পনা ছিনতাই হয়ে যায়। অন্তর বেদনাহত হয়ে থাকে।
আ. মুজাহাদার প্রতিদান মুজাহাদার চেয়ে বেশি।
ম. ইংরেজির কাজ একেবারে বন্ধ করে প্রথম পারার উদুর্ ভাষান্তর করছি। সেটাকে পরিষ্কার করে লেখাচ্ছিও। কোনো বাধা না পড়লে আগামী সপ্তাহে আপনার খেদমতে পাঠিয়ে দেব।
আ. ইনশাআল্লাহ। তবে দেখার ব্যাপারে পরামর্শ দিন। পূর্ণ দেখা এবং গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখার সাহস তো নেই। তাহলে কীভাবে দেখব?
ম. ইতিহাস, ভূগোল ও ইহুদী—খ্রিষ্টানদের কিতাব অনেক বেশি অধ্যয়ন করতে হচ্ছে। লেখার চেয়ে পড়ায় বেশি সময় যাচ্ছে। শনিবারের ব্যাপারে ইহুদীদের যে ঘটনা কোরআন মাজীদে এসেছে মুফাসসিরগণ এ ব্যাপারে শুধু এটুকু লিখেছেন, এ ঘটনা আইলা নামক স্থানে সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু এ নাম বর্তমানের কোনো ম্যাপে পাওয়া যায় না। কয়েকদিন এটা নিয়ে পেরেশান ছিলাম। শেষে তাওরাতে এর আলোচনা প্রসঙ্গক্রমে পেয়ে যাই। সেখানে জায়গার নাম লেখা ছিল আইলাত। শেষ পর্যন্ত জানা গেছে, এর নাম বারবার পরিবর্তন হয়েছে। আধুনিক ভূগোলে এর নাম আকাবা, যা শামের দক্ষিণে এবং আরবের উত্তরপূর্ব দিকে লোহিত সাগরের মুখে অবস্থিত। সেখানকার সমুদ্র আকাবা উপসাগর নামে প্রসিদ্ধ। সময়ও মোটামুটি নির্ধারিত হয়েছে। দাউদ আ.—এর সময়কার ঘটনা। এটি একটি উদাহরণ হিসেবে পেশ করলাম। ইচ্ছে হয়, ইহুদী, নাসারা ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের যত ঘটনা ও আকীদা কোরআন মাজীদে বর্ণিত হয়েছে সবার সনদ তাদের কিতাব থেকেই যদি ব্যবস্থা হয়ে যেত। অবশ্য এর জন্য অনেক সময়ের প্রয়োজন। সঙ্গে কিতাবের স্তুপ জোগাড়ের জন্য বড় পুঁজির প্রয়োজন।
আ. আল্লাহ তাআলা সহজ করুন। তবে لَا یُکَلِّفُ اللهُ نَفْسًا اِلَّا وُسْعَهَا
ম. হযরত তো দুআ করেন।
আ. মনে—প্রাণে।
ম. শুনেছি কিছুদিন আগে খোদ আপনারই স্বাস্থ্য খারাপ ছিল।
আ. খুব বেশি খারাপ হয়নি। নাক থেকে রক্ত পড়া শুরু হয়েছিল। কয়েক ঘণ্টা পর বন্ধ হয়। একদিন কিছুটা দুর্বলতাও ছিল। এরপর নির্লজ্জতার জীবন পার করছি। নিশ্চিন্ত থাকুন।
ম. আল্লাহর করুণায় এখন একেবারে সুস্থ হয়ে গিয়ে থাকবেন। ভালো ও সুস্থতার ব্যাপারে অবশ্যই অবহিত করবেন।
আ. আলহামদুলিল্লাহ পরিপূর্ণ ভালো আছি।
ফাঁকে ফাঁকে যে সূক্ষ্ম ও প্রজ্ঞাপূর্ণ সঠিক আকীদার উপস্থিতি আখলাক সংশোধনের সঙ্গে সঙ্গে এসেছে সেগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থাকলে কিতাবের কলেবর দ্বিগুণ হয়ে যাবে। সেসব সূক্ষ্ম ও চমকপ্রদ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়োজনই—বা কী। পাঠকদের মধ্যে কে এমন অবোধ যে তার সামনে এসব বিষয় আপনাতেই উন্মোচিত হবে না।
চিঠি আদান—প্রদান এখন সাধারণত তাফসীরে কোরআন নিয়েই হয়। কখনো কখনো স্বপ্ন ইত্যাদিও চিঠির বিষয়বস্তু হয়ে যায়। স্বপ্ন শুধু নিজের নয়, স্ত্রীরও। তাঁর সম্ভবত ভালো স্বপ্নের সঙ্গে কোনো বিশেষ সম্পর্ক ছিল। কমপক্ষে ওই সময় তো ছিল। ৩রা জুনের লম্বা পত্র স্ত্রীরই বড় আনন্দদায়ক স্বপ্নে পরিপূর্ণ ছিল। মূল স্বপ্ন এখানে উল্লেখ বেশি একটা স্থান উপযোগী হবে না। তবে আনন্দের জবাব ছেড়ে দেওয়া যাচ্ছে না। জবাবটুকুই শুধু দেখুন।
‘বিস্তারিত ব্যাখ্যার সঙ্গে তো আমার সম্পর্ক নেই। সংক্ষেপে এটুকু মনে হয়, আপনার কোরআনের খেদমতের প্রতি পূর্ববতী বুযুর্গগণের বিশেষ রুহানী তাওয়াজ্জুহ আছে। সেসবই বিশেষ আকৃতিতে দেখা গিয়েছে। আর স্থায়ীভাবে থাকার অর্থ এটা মনে হয়, এখন এ তাওয়াজ্জুহ খেদমত শেষ হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। আল্লাহ ভালো জানেন।’
আফসোস করে বলেছিলাম, ‘আহ! এ স্বপ্নের কোনো অংশ জাগ্রত অবস্থায়ও যদি নসীব হতো।’
উত্তরে হযরত বলেন, ‘ইনশাআল্লাহ সব নসীব হবে। হোক তা মর্মগতভাবে।’
[চলবে, ইনশাআল্লাহ]