হাদীস ও আছারের আলোকে জুমার আগের ও পরের সুন্নত
মাওলানা মুহাম্মদ মামুন
জুমার নামায ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। ইসলামের শিআর তথা প্রতীক ও নিদর্শন। প্রত্যেক বালেগ, মুকীম, সুস্থ ও মসজিদে গমনে সক্ষম পুরুষের ওপর জুমার নামায জামাতের সঙ্গে আদায় করা ফরযে আইন। জুমার নামাযের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সকল নির্দেশনা প্রদান করেছেন তা থেকেই জুমার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য বুঝে আসে। যেমন : জুমার দিন গোসল করে সুগন্ধি মেখে মসজিদে যাওয়া, আগে আগে মসজিদে যাওয়া, খতীব সাহেব আগমন করলে নীরবে খুতবা শোনা। খুতবা চলাকালে কোনো ধরনের কথাবার্তা না বলা ইত্যাদি। এ নিবন্ধে আমরা জুমার নামায প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর নির্দেশনাগুলো নির্ভরযোগ্য হাদীসের আলোকে তুলো ধরার চেষ্টা করব।
জুমার দিনের কিছু আদব
০১. হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
مَنِ اغْتَسَلَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ غُسْلَ الْجَنَابَةِ ثُمَّ رَاحَ فَكَأَنَّمَا قَرَّبَ بَدَنَةً، وَمَنْ رَاحَ فِي السَّاعَةِ الثَّانِيَةِ فَكَأَنَّمَا قَرَّبَ بَقَرَةً، وَمَنْ رَاحَ فِي السَّاعَةِ الثَّالِثَةِ فَكَأَنَّمَا قَرَّبَ كَبْشًا أَقْرَنَ، وَمَنْ رَاحَ فِي السَّاعَةِ الرَّابِعَةِ فَكَأَنَّمَا قَرَّبَ دَجَاجَةً، وَمَنْ رَاحَ فِي السَّاعَةِ الْخَامِسَةِ فَكَأَنَّمَا قَرَّبَ بَيْضَةً، فَإِذَا خَرَجَ الإِمَامُ حَضَرَتِ الْمَلاَئِكَةُ يَسْتَمِعُونَ الذِّكْرَ .
যে ব্যক্তি জুমার দিন ফরয গোসল করার মতো (ভালোভাবে) গোসল করে (জুমার নামাযের জন্য) রওনা করে, সে যেন একটি উট আল্লাহর রাস্তায় দান করল। অতঃপর দ্বিতীয় পর্যায়ে যে আসে সে যেন একটি গাভি দান করল। তৃতীয় পর্যায়ে যে আসে সে যেন একটি বকরি দান করল। চতুর্থ পর্যায়ে যে এলো সে যেন একটি মুরগি দান করল। পঞ্চম পর্যায়ে যে এলো সে যেন একটি ডিম দান করল। এরপর যখন ইমাম সাহেব (খুতবার উদ্দেশ্যে) বের হন তখন ফেরেশতারা যিকির—খুতবা শোনায় মনোনিবেশ করে।—সহীহ বুখারী, হাদীস : ৮৮১
এ হাদীসে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর নির্দেশনা হলো, জুমার নামাযে আগে আগে আসার জন্য প্রতিযোগিতা করা। জুমার ওয়াক্তের প্রথম অংশ থেকে শুরু করে খতীব সাহেব আরবী খুতবার জন্য মিম্বরে উঠা পর্যন্ত সময়টাকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যারা আগে আসার জন্য প্রতিযোগিতা করবে এবং প্রথম অংশে মসজিদে চলে আসবে, তাদের আমলনামায় একটি উট আল্লাহর রাস্তায় দান করার সওয়াব লেখা হয়। যে যত আগে আসে তত বড় পশু সদকা করার সওয়াব পায়। পর্যায়ক্রমে সওয়াব কমতে থাকে।
২. হযরত সালমান ফারেসী রাযি. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন :
لاَ يَغْتَسِلُ رَجُلٌ يَوْمَ الْجُمُعَةِ، وَيَتَطَهَّرُ مَا اسْتَطَاعَ مِنْ طُهْرٍ، وَيَدَّهِنُ مِنْ دُهْنِهِ، أَوْ يَمَسُّ مِنْ طِيبِ بَيْتِهِ ثُمَّ يَخْرُجُ، فَلاَ يُفَرِّقُ بَيْنَ اثْنَيْنِ، ثُمَّ يُصَلِّي مَا كُتِبَ لَهُ، ثُمَّ يُنْصِتُ إِذَا تَكَلَّمَ الإِمَامُ، إِلاَّ غُفِرَ لَهُ مَا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْجُمُعَةِ الأُخْرَى.
কোনো পুরুষ যখন জুমার দিন গোসল করে, সাধ্যমতো পবিত্রতা অর্জন করে, তেল ব্যবহার করে অথবা ঘরে যে সুগন্ধি আছে তা ব্যবহার করে (জুমার নামাযের জন্য) বের হয় এবং (মসজিদে এসে বসার জন্য) দুই জনকে আলাদা করে না (বরং যেখানে জায়গা পায় সেখানে দাঁড়িয়ে), তারপর তাওফীকমতো নামায আদায় করে, তারপর ইমাম যখন খুতবা দেয় তখন চুপ থাকে—পরবতীর্ জুমা পর্যন্ত তার (গোনাহ) মাফ করে দেওয়া হয়।—সহীহ বুখারী, হাদীস : ৮৮৩; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস : ২৭৭৬
৩. হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন :
مَنِ اغْتَسَلَ ثُمَّ أَتَى الْجُمُعَةَ فَصَلَّى مَا قُدِّرَ لَهُ ثُمَّ أَنْصَتَ حَتَّى يَفْرُغَ مِنْ خُطْبَتِهِ ثُمَّ يُصَلِّيَ مَعَهُ غُفِرَ لَهُ مَا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْجُمُعَةِ الأُخْرَى وَفَضْلَ ثَلاَثَةِ أَيَّامٍ.
যে ব্যক্তি গোসল করে জুমার নামাযে আসে, এরপর তাওফীকমতো নামায পড়ে এবং খুতবা শেষ হওয়া পর্যন্ত নীরব থাকে, অতঃপর ইমামের সাথে ফরয নামায আদায় করে—পরবতীর্ জুমা পর্যন্ত এবং আরও অতিরিক্ত তিন দিনের (গোনাহ) মাফ করে দেওয়া হয়।—সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৮৫৭
৪. হযরত নুবাইশা হুযালী রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন :
إنَّ المُسْلِمَ إذَا اغْتَسَلَ يَوْمَ الجُمُعَةِ، ثُمَّ أَقْبَلَ إلى المَسْجِدِ، لا يُؤْذِي أَحَدًا، فَإنْ لَمْ يَجِدِ الإمامَ خَرَجَ صَلَّى مَا بَدَا لَه، وَإنْ وَجَدَ الإمَامَ قَدْ خَرَجَ جَلَسَ، فَاسْتَمَعَ وأَنْصَتَ حَتَّى يَقْضِيَ الإمَامُ جُمُعَتَه وكَلَامَه، إنْ لَمْ يُغْفَرْ لَه في جُمُعَتِه تِلْكَ ذُنُوْبُه كُلُّهَا أنْ تَكُوْنَ كَفَّارَةً لِلْجُمُعَةِ التِي تَلِيْها.
কোনো মুসলমান যখন জুমার দিন গোসল করে মসজিদের দিকে রওনা হয় এবং (মসজিদে) কাউকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকে। ইমাম (খুতবার জন্য) বের হয়নি দেখলে যে পরিমাণ ইচ্ছা নামায পড়ে। যদি দেখে ইমাম বের হয়ে গেছে, তাহলে বসে যায় এবং ইমামের নামায ও খুতবা শেষ হওয়া পর্যন্ত নীরবে মনোযোগ দিয়ে শোনে। তাহলে এ ব্যক্তির এ সপ্তাহের সকল গোনাহ যদি মাফ নাও হয় এ তো অবশ্যই হবে যে, পরবর্তী জুমার জন্য তা কাফ্ফারা হয়ে যায়।—মুসনাদে আহমাদ, হাদীস—২০৭২
৫. হযরত আবু দারদা রাযি. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
مَنْ اغْتَسَلَ يَوْمَ الجُمُعَةِ، وَلَبِسَ ثِيَابَه، وَمَسَّ طِيْبًا إنْ كَانَ عِنْدَه، ثُمَّ مَشٰى إلى الجُمُعَةِ وَعَلَيْه السَّكِيْنَةُ، وَلَمْ يَتَخَطَّ اَحَدًا، وَلَمْ يُؤْذِه، وَرَكَعَ مَا قَضي له، ثُمَّ انْتَظَرَ حَتى يَنْصَرِفَ الإمَامُ، غَفَرَ لَه مَا بَيْنَ الجُمُعَتَيْنِ.
যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করে, এরপর তার (উত্তম) পোশাক পরিধান করে, তার কাছে সুগন্ধি থাকলে তা ব্যবহার করে, এরপর ধীরস্থিরভাবে জুমার দিকে যায়, কাউকে ডিঙিয়ে (সামনে) যাওয়া থেকে বিরত থাকে, কাউকে কষ্ট দেয় না, তাওফীকমতো নামায আদায় করে, এরপর ইমাম ফরয নামায শেষ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করে, তার দুই জুমার মাঝে যা (গোনাহ) হয়েছে তা মাফ করে দেওয়া হয়।—মুসনাদে আহমাদ, হাদীস : ২১৭২৯
উল্লিখিত পাঁচটি হাদীস থেকে আমরা যে নির্দেশনাগুলো পেলাম তা হলো :
০১. জুমার দিন গোসল করে মসজিদে আসা এবং খুব ভালোভাবে গোসল করা।
০২. সাধ্যমতো ভালো কাপড় পরিধান করা।
০৩. সুগন্ধি ব্যবহার করা।
০৪. আগে আগে মসজিদের দিকে রওনা হওয়া।
০৫. ঘর থেকে বের হয়ে ধীর পদে মসজিদে আসা। তাড়াহুড়া বা দৌড়—ঝাঁপ করে মসজিদে না আসা।
০৬. মসজিদে এসে যেখানে জায়গা পাবে দাঁড়াবে। কাউকে ডিঙিয়ে সামনে যাবে না। যে দুজন একসঙ্গে বসেছে তাদের আলাদা করে মাঝে বসবে না।
০৭. ইমাম সাহেব (আরবী) খুতবার জন্য মিম্বরে আরোহণ না করে থাকলে নফল ও সুন্নতে মুআক্কাদা নামায আদায় করবে। হাতে সময় থাকলে কাবলাল জুমার আগে তাহিয়্যাতুল ওযু ও তাহিয়্যাতুল মসজিদ আদায় করা। ইমাম খুতবার জন্য মিম্বরে এলে চুপচাপ বসে খুতবা শুনবে।
জুমার আগের ও পরের সুন্নত
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমার দিন জুমার আগে ও পরে কোনো নামায আদায় করতেন কি না, হাদীসে তার সুস্পষ্ট বর্ণনা আছে। এখানে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের নির্দেশনা ও আমল—সংবলিত কিছু বর্ণনা তুলে ধরা হলো।
হযরত আলী রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :
كَانَ النبي صلى الله عليه و سلم يَرْكَعُ قَبْلَ الجُمُعَةِ اَرْبَعًا لا يَفْصِلُ في شَيْءٍ مِنْهُنَّ.
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমার আগে চার রাকাত পড়তেন। মাঝে (সালাম দ্বারা) আলাদা করতেন না। (অর্থাৎ এক সালামে চার রাকাত আদায় করতেন।)—আলফাওয়ায়িদুল মুনতাক্বাত—এর সনদের সূত্রে তরহুত তাছরীব, আবু যুরআ ইরাকী রহ. : ৩/৩৬
বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্য হেলার পর অর্থাৎ যোহরের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার পর প্রতিদিন চার রাকাত নামায আদায় করতেন। কোনো দিন বাদ দিতেন না। সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে যাওয়ার পর সপ্তাহের ছয় দিন আমরা যোহর পড়ি আর শুক্রবার দিন জুমার নামায আদায় করি। এই চার রাকাত নামায সপ্তাহের সাত দিনই তিনি পড়তেন। ছয় দিন ‘কাবলায যোহর’ আর একদিন ‘কাবলাল জুমা’। ‘কাবলা’ আরবী শব্দ, যার অর্থ আগে। যোহরের আগে পড়া হলে ‘কাবলায যোহর’ আর জুমার আগে পড়া হলে ‘কাবলাল জুমা’। যেহেতু সপ্তাহের ছয় দিন তা কাবলায যোহর তাই হাদীসে একে বলা হয়েছে কাবলায যোহর। তবে নামায পড়ার যে বিশেষ কারণ তিনি উল্লেখ করেছেন তা সপ্তাহের অন্যান্য দিনের মতো জুমার দিনেও বিদ্যমান। যেমন : এক হাদীসে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সাইব রাযি. বর্ণনা করেন :
أَنَّ رَسُوْلَ الله صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يُصَلِّي أَرْبَعاً بَعْدَ أَنْ تَزُولَ الشَّمْسُ قَبْلَ الظُّهْرِ، وَقَال: إِنَّهَا سَاعَةٌ تُفْتَحُ فِيهَا أَبْوَابُ السَّمَاءِ، فَأُحِبُّ أَنْ يَصْعَدَ لِي فِيهَا عَمَلٌ صَالِحٌ.
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্য হেলার পর যোহরের আগে চার রাকাত নামায আদায় করতেন। তিনি বলেছেন, এই সময় (সূর্য হেলার পর) আসমানের দরজাসমূহ খোলা হয়। আমি চাই এ সময় আমার কোনো নেক আমল ওপরে যাক।—আশ—শামাইলুল মুহাম্মাদিয়্যাহ, হাদীস : ২৯৫; জামে তিরমিযী, হাদীস : ৪৮২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস : ১৫৩৯৬
হযরত আবু আইয়ুব আনছারী রাযি. থেকে বর্ণিত :
أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، كَانَ يُدْمِنُ أَرْبَعَ رَكَعَاتٍ عِنْدَ زَوَالِ الشَّمْسِ، فَقُلْتُ : يَا رَسُولَ اللَّهِ، إِنَّكَ تُدْمِنُ هَذِهِ الأَرْبَعَ رَكَعَاتٍ عِنْدَ زَوَالِ الشَّمْسِ، فَقَالَ : إِنَّ أَبْوَابَ السَّمَاءِ تُفْتَحُ عِنْدَ زَوَالِ الشَّمْسِ فَلا تُرْتَجُ حَتَّى تُصَلَّى الظُّهْرُ ، فَأُحِبُّ أَنْ يَصْعَدَ لِي فِي تِلْكَ السَّاعَةِ خَيْرٌ، قُلْتُ : أَفِي كُلِّهِنَّ قِرَاءَةٌ ؟ قَالَ : نَعَمْ. قُلْتُ : هَلْ فِيهِنَّ تَسْلِيمٌ فَاصِلٌ؟ قَالَ : لا.
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা সূর্য হেলার পর চার রাকাত নামায পড়তেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি সর্বদা সূর্য হেললে চার রাকাত নামায পড়েন (এর তাৎপর্য কী?)।
তিনি বললেন, সূর্য হেলার পর আসমানের দরজা খোলা হয়। এরপর যোহরের ফরয পড়া পর্যন্ত বন্ধ করা হয় না। আমি চাই ওই সময় আমার কোনো নেক আমল ওপরে যাক।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, প্রতি রাকাতে কি কোরআন পড়তে হবে?
তিনি বললেন, হ্যাঁ।
আমি বললাম, মাঝে কি সালাম ফেরাতে হবে?
তিনি বললেন, না।—আশ—শামাইলুল মুহাম্মাদিয়্যাহ, হাদীস : ২৯৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস : ২৩৫৩২
অপর হাদীসে এসেছে :
إنَّ اَبْوَابَ الجَنَّةِ تُفْتَحُ عِنْدَ زَوَالِ الشَّمْسِ فَلاَ تُرْتَجُ حَتّى تُقَامُ الصَّلَاةُ فَاُحِبُّ اَنْ اُقَدِّمَ.
সূর্য হেলে গেলে জান্নাতের দরজাগুলো খোলা হয়। এরপর (ফরয) নামায শুরু হওয়া পর্যন্ত বন্ধ করা হয় না। এ কারণে আমি (কিছু আমল) পাঠাতে চাই।—মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ, হাদীস : ৫৯৯২
শায়খ মুহাম্মদ আওয়ামাহ দা. বা. আব্দুল্লাহ ইবনে সায়েব রাযি. ও আবু আইয়ুব আনছারী রাযি.—এর হাদীসের সনদ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহর টীকায় লিখেছেন :
فَهَذَا المَعْنى هُوَ حُجَّة لمَنْ يَقُوْلُ بِسُنِّيَةِ اَرْبَعِ رَكَعَاتٍ قَبْلَ فَرْضِ الجُمُعَةِ لِأنَّ فَتْحَ اَبْوَابِ السَّمَاءِ أَوِ الجَنَّةِ مَنَاطٌ بِزَوَالِ الشَّمْسِ و هَذَا مُتَحَقِّقٌ في يَوْمِ الجُمُعَة و غَيْرِه.
যারা জুমার ফরযের পূর্বে চার রাকাত সুন্নতের কথা বলেন এ হাদীসই তাদের দলিল। কেননা আসমান কিংবা জান্নাতের দরজা খোলাটা সূর্য হেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ অবস্থা জুমার দিন ও অন্যান্য দিনে সমানভাবে বিদ্যমান।—মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবার টীকা : ৪/১১৫—১১৬
আল্লামা যাইনুদ্দীন ইরাকী রহ. বলেছেন :
بِأَنَّه حَصَلَ فِي الجُمْلَةِ اِسْتِجَابُ اَرْبَعٍ بَعْدَ الزَّوَالِ كُلَّ يَوْمٍ. سَوَاءً يَوْمَ الجُمُعَةِ وَغَيْرِهَا وَ هُوَ المَقْصُوْدُ.
এ হাদীস থেকে সূর্য হেলার পর প্রতিদিন জুমার দিন হোক আর অন্য কোনো দিন হোক চার রাকাত নামায পড়া উত্তম (সুন্নত) প্রমাণিত হয়। আর এটাই উদ্দেশ্য।—ফয়যুল কাদীর, হাদীস : ৭০৭১
হযরত আলী রাযি. বলেন :
كَانَ رَسُوْلُ الله صَلى الله عليه وسلم يُصَلِّي قَبْلَ الجُمُعَةِ اَرْبَعًا وَ بَعْدَهَا اَرْبَعًا وَ يَجْعَلُ التَسْلِيْمَ في اٰخِرِهِنَّ.
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমার আগে চার রাকাত এবং জুমার পরে চার রাকাত নামায পড়তেন এবং সর্বশেষ রাকাতে সালাম ফেরাতেন।—আলমুজামুল আওসাত, তবারানী : ২/৩৬৮
হযরত আবু হুরায়রা রাযি. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন :
اِذَا صَلّى اَحَدُكُمْ الْجُمُعَةَ فَلْيُصَلِّ بَعْدَهَا أَرْبَعًا.
তোমাদের কেউ যখন জুমার নামায আদায় করে তখন যেন সে অবশ্যই তার পরে চার রাকাত নামায আদায় করে।—সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২০৩৬
হযরত আলী রাযি. কতৃর্ক বর্ণিত হাদীস থেকে বোঝা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমার পর চার রাকাত নামায আদায় করতেন। অপর হাদীসে এসেছে, তিনি জুমার পর ঘরে গিয়ে দুই রাকাত নামায আদায় করতেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত :
إن النبي صلى الله عليه و سلم كان يصلي بعد الجمعة ركعتين في بيته.
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমার নামায আদায়ের পর ঘরে গিয়ে দুই রাকাত নামায আদায় করতেন।—সুনানে আবু দাঊদ, হাদীস : ১১৩২
উল্লিখিত হাদীসগুলো থেকে বোঝা গেল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা জুমার আগে চার রাকাত ও পরে চার রাকাত নামায আদায় করতেন। ফিক্হের পরিভাষায় এ নামাযকে সুন্নতে রাতিবা (সুন্নতে মুআক্কাদা) বলা হয়। আমরা জুমার আগের চার রাকাতকে ‘কাবলাল জুমা’ এবং পরের চার রাকাতকে ‘বা’দাল জুমা’ বলা হয়। কাবলাল জুমা ছুটে গেলে জুমার ফরযের পর আদায় করা যাবে। এ ক্ষেত্রে পূর্বের চার রাকাত সুন্নত পড়ছি এমন নিয়তই যথেষ্ট হবে।
এবার আমরা সাহাবায়ে কেরামের আমল ও নির্দেশনা তুলে ধরব :
১. তাবেয়ী জাবালা ইবনে সুহাইল রহ. বলেন :
عن ابن عمر اَنَّه كَانَ يُصَلِّي قَبْلَ الجُمُعَةِ اَرْبَعًا لَا يَفْصِلُ بَيْنَهُنَّ بِسَلاَمٍ ثُمَّ بَعْدَ الجُمُعَةِ رَكْعَتَيْنِ ثُمَّ اَرْبَعًا.
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. জুমার আগে চার রাকাত নামায আদায় করতেন। মাঝে সালাম ফেরাতেন না। অতঃপর জুমার নামাযের পর দুই রাকাত, এরপর চার রাকাত নামায পড়তেন।—শরহু মাআনিল আছার, ইমাম ত্বহাবী : ১৬৪—১৬৫
২. তাবেয়ী কাতাদা রহ. বলেন :
اِنَّ اِبْنَ مَسْعُوْدٍ كَانَ يُصَلِّي قَبْلَ الجُمُعَةِ اَرْبَعَ رَكْعَاتٍ وَ بَعْدَهَا اَرْبَعَ رَكْعَاتٍ.
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. জুমার আগে চার রাকাত নামায পড়তেন। জুমার পরেও চার রাকাত আদায় করতেন।—মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদীস : ৫৫২৪
৩. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. সম্পর্কে বর্ণিত আছে :
اَنَّه كَانَ يُصَلِّي يَوْمَ الجُمُعَةِ فِي بَيْتِه اَرْبَعَ رَكْعَاتٍ ثُمَّ يَأْتِى المَسْجِدَ فَلاَ يُصَلِّي قَبْلَهَا وَ لا بَعْدَها.
তিনি জুমার দিন নিজ ঘরে চার রাকাত পড়তেন। এরপর মসজিদে আসতেন এবং জুমার আগে (মসজিদে) কোনো নামায পড়তেন না। জুমার পরও (মসজিদে কোনো নামায) পড়তেন না।—ফাতহুল বারী, ইবনে রজব হাম্বলী : ৫/৫৮০
৪. তাবেয়ী আমর ইবনে সায়ীদ ইবনুল আস রহ. বলেন :
كُنْتُ أرَى اَصْحَابَ رَسُولِ اللهِ صلى اللهُ عليهِ و سلمَ فإذا زَلَّتِ الشَّمْسُ يَوْمَ الجُمُعَةِ قَامُوْا فَصَلُّوْا أَرْبَعًا.
আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর সাহাবীগণকে দেখতাম, জুমার দিন সূর্য যখন হেলে যেত (অর্থাৎ জুমার ওয়াক্ত শুরু হতো) তখন তাঁরা দাঁড়িয়ে যেতেন এবং চার রাকাত নামায পড়তেন।—আততামহীদ : ৪/২৬; তাহযীবুত তাহযীব : ১০/২৯৭
৫. তাবেয়ী ইবরাহীম নাখায়ী রহ. সাহাবী ও তাবেয়ীগণের কর্মপন্থা উল্লেখ করে বলেন :
كَانُوْا يُحِبُّوْنَ اَنْ يُصَلُّوْا قَبْلَ الجُمُعَةِ اَرْبَعًا.
তাঁরা জুমার আগে চার রাকাত নামায পড়া পছন্দ করতেন।
ইবরাহীম নাখায়ী রহ. বলেন :
مَا قُلْتُ لَكُمْ : كَانُوْا يَسْتَحِبُّوْنَ فَهُوَ الذَّى اَجْمَعُوْا عَلَيْهِ.
যখন আমি তোমাদেরকে كانو يستحبون (তাঁরা পছন্দ করতেন) বলব, তখন বুঝতে হবে তা এমন বিষয়, যার ওপর তাঁদের ইজমা ছিল।—ফাতহুল বারী, ইবনে রজব হাম্বলী : ৫/৫৪০
সাহাবায়ে কেরাম শুধু নিজে জুমার আগে ও পরে নামায পড়তেন এমন নয়। তারা অন্যদেরও এ ব্যাপারে নির্দেশ দিতেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি.—এর বিশিষ্ট ছাত্র আবু আব্দুর রহমান আসসুলামী রহ. বলেন :
كَانَ عَبْدَ اللهِ يَأْمُرُ أنْ نُصَلِّىَ قَبْلَ الجُمُعَةِ اَرْبَعًا وَ بَعْدَهَا اَرْبَعًا حَتى جَاءَنَا عَلِيٌّ فَأَمَرَنَا اَنْ نُصَلَّىَ بَعْدَهَا رَكَعَتَيْنِ ثُمَّ اَرْبَعًا.
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রহ. আমাদেরকে জুমার আগে চার রাকাত এবং জুমার পরে চার রাকাত পড়ার আদেশ করতেন। পরে যখন আলী রাযি. আগমন করলেন তখন আমাদেরকে জুমার পরে প্রথমে দুই রাকাত এরপর চার রাকাত পড়ার আদেশ করলেন।—মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক : ৫৫২৫
তাবেয়ী আতা রহ. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. সম্পর্কে বলেন :
أنه رأى ابن عمر يصلي يوم الجمعة فيتقدم عن مصلاه الذي صلى فيه الجمعة قليلا غير كثير فيركع ركعتين قال : ثم يمشي أنفس من ذلك فيركع أربع ركعات قلت لعطاء : كم رأيت ابن عمر يصنع ذلك ؟ قال : مرارا.
তিনি তাকে দেখেছেন যে, তিনি জুমার নামায শেষ হওয়ার পর জায়নামায থেকে কিছুটা সরে দুই রাকাত পড়তেন। অতঃপর আরেকটু সরে চার রাকাত পড়তেন। বর্ণনাকারী বলেন, আমি আতা রহ.—কে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি আব্দুল্লাহ ইবনে উমরকে কতবার এমন করতে দেখেছেন?
তিনি বললেন, বহুবার।—মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস নং : ১১০১
উল্লিখিত হাদীস ও আছারে যেমন জুমার ফরযের পর চার রাকাত নামাযের কথা এসেছে তেমনই দুই রাকাতের কথাও এসেছে। চার রাকাত হলো সুন্নতে মুআক্কাদা। আর দুই রাকাত সুন্নতে যায়েদাহ। এ দুই রাকাত বা’দাল জুমার চার রাকাত আদায়ের পর পড়বে। এ হাদীস দুটি থেকে বাহ্যত যদিও চার রাকাত আগে পড়ার কথা বুঝে আসে। তবে এ প্রসঙ্গে বর্ণিত সকল রিওয়ায়াত ও ফকীহগণের বক্তব্য থেকে, বিশেষ করে হানাফী ফকীহগণের বক্তব্য থেকে বুঝে আসে, এ দুই রাকাত বা’দাল জুমার চার রাকাতের পরই আদায় করবে। ফুকাহায়ে কেরামের একটি মূলনীতি হলো, ফরযের পর এমন নামায আদায় না করা যা হুবহু ফরযের সঙ্গে মিলে যায়। এতে মানুষ মনে করতে পারে, ফরয নামাযে ভুল হওয়ার কারণে সে নামায দোহরানো হচ্ছে। এ কারণে যে সকল ফরয নামাযের পর সুন্নত আছে সে নামাযগুলোর রাকাতসংখ্যা সে ওয়াক্তের ফরযের সমান নয়। অতএব জুমার দুই রাকাত ফরয আদায়ের পর দুই রাকাত সুন্নতে যায়েদাহ না পড়ে চার রাকাত বা’দাল জুমা আগে আদায় করবে। পরে দুই রাকাত আদায় করবে। যেমন জোহরের আগের চার রাকাত সুন্নত ছুটে গেলে তা জোহরের চার রাকাত ফরযের পর পর আদায় করবে না। বরং তা আদায় করতে হয় জোহরের পরের দুই রাকাত সুন্নত আদায়ের পর।
বিষয়টি ফিক্হের নিম্নের কিতাবগুলোতে দেখা যেতে পারে :
—বাদায়েউস সানায়ে : ২/২৬৫; আল—মুহীতুল বুরহানী : ৮/২৩৪, ২/২৩৫; গুনইয়াতুল মুতামাল্লী, পৃ. ৩৮৮—৩৮৯; হাশিয়াতুত তাহতাবী : ৩৮৯—৩৯০; আদ্দুররুল মুখতার : ৪/৪১০; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া : ২/৩০২
আল্লাহ পাক আমাদেরকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের সুন্নাহ অনুসরণের তাওফীক দান করুন।