আল—হাইআতুল উলিয়াকে বাঁচিয়ে রাখা ও তৎপর করা সময়ের দাবি
ইদানীং একটি কথা বাজারে এসেছে যে, আলহাইয়াতুল উলিয়া বিলুপ্ত করে একটি সমন্বিত কওমি শিক্ষাবোর্ড করা হবে। এর তত্ত্বাবধানে থাকবে শিক্ষামন্ত্রণালয়। তারা কওমি শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন করবে। অথচ এমন কোনো কথা ছিল না। একটু বিশ্লেষণ করলে সহজেই বোঝা যাবে যে, দেশের সকল কওমি মাদরাসার সম্মিলিত কতৃর্পক্ষের আওতায় ছয়টি বোর্ড এবং এসবের সাথে সম্পৃক্ত সকল কওমি মাদরাসা ঐক্যবদ্ধ। একটি সংসদীয় বিলের মাধ্যমে আল—হাইয়াতুল উলিয়াকে মূল রেখে কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদীসকে আরবী ও ইসলামী শিক্ষায় এমএর মান দেওয়া হয়েছে। এই বিলে স্পষ্ট লেখা আছে, কওমি মাদরাসার বিষয়ে সরকার কোনো দিন হস্তক্ষেপ করবে না। এখানে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের মৌলিক আক্বীদা, চার ফিকহী মাযহাব, চার তরীকা, আশআরী, মাতুরীদি ব্যাখ্যায় ভারসাম্যপূর্ণ আক্বীদা, উপমহাদেশের ওলামায়ে কেরামের স্বাধীনতা আন্দোলন, বিশেষ করে দেওবন্দের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হযরত কাসেম নানুতবী রহ. বিবৃত উসূলে হাশতেগানা অক্ষুণ্ণ রেখে ঐতিহ্যবাহী কওমি ধারার শিক্ষাকে এ অঞ্চলের সর্বপ্রাচীন জাতীয় শিক্ষা হিসেবে স্বীকার করে স্বাধীন ও স্বকীয় মর্যাদার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
কওমি অঙ্গনের সকলকে সতর্কভাবে পথ চলতে হবে। যে—কোনো মূল্যে আলহাইআতুল উলিয়াকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। স্মরণকালের সেরা কওমি মুরুব্বী আলহাইআতুল উলিয়া ও বেফাকুল মাদারিসের সম্মানিত সভাপতি, দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার প্রায় তিন যুগের মুহতামিম আল্লামা শাহ আহমদ শফী এই হাইআতুল উলিয়া গঠন করে গেছেন। তার হাত ধরেই কওমি মাদরাসার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তিনি দারুল উলূম দেওবন্দের আদলে স্বাধীন স্বীকৃতি নিয়েছেন। কওমি শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন বা উন্নয়ন কওমি মুরুব্বীরাই করবেন। এতে শিক্ষা ও পরিচালনাগত কোনো দিক দিয়ে ওলামায়ে কেরাম ছাড়া জনগণ বা সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না। এসব হতে দিলে কওমি মাদরাসাও নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে ব্যর্থ শিক্ষাব্যবস্থায় পরিণত হবে। আলহাইআতুল উলিয়ার সকল বোর্ড এবং জিম্মাদারদের খুব সতর্ক, নির্লোভ চরিত্র ও ঐতিহাসিক দৃঢ় অবস্থান ধরে রাখতে হবে। কোনো ভুল করে একজন ব্যক্তিরও পদস্খলন হতে পারবে না। এমন নীতি, আদর্শ ও কর্মপন্থার ওপর সিসাঢালা প্রাচীরের মতো জমে থাকতে পারলে কওমি শিক্ষা তথা ইসলামের মূল জ্ঞানগত রূপ অক্ষুণ্ণ থাকবে। যারা নিজেদের দুর্বল বলে মনে করেন আল্লাহর ওয়াস্তে তারা এসব স্থানে গুরুদায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে নিজেকে সুরক্ষিত করুন। ব্যক্তিগত ভয় ও চাপ কিংবা লোভ, লালসার ফলে এ দেশের কওমি শিক্ষার মেরুদণ্ডকে ভেঙে দেবেন না।
পাশাপাশি কওমি অঙ্গনের কিছু উদ্বেগ ও হতাশা তাদেরই দূর করতে হবে। স্বীকৃতির পরিমিত সুফল শিক্ষার্থীদের দুয়ারে পৌঁছাতে হবে। দ্বীনি শিক্ষার ১৬ আনা বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে প্রয়োজন পরিমাণ দেশীয় শিক্ষাও সিলেবাসভুক্ত করা যায়। যাতে বাংলাদেশের অন্য শিক্ষিত লোকেদের সাধারণ যোগ্যতার সমান পড়ালেখা কওমি মাদরাসায়ও থাকে। একজন আলেম যিনি মাস্টার্স সমমানের সনদ লাভ করবেন, তার দেশীয় সাধারণ শিক্ষার প্রয়োজনীয় অংশ খুবই প্রয়োজন। তা ছাড়া দুনিয়ার অন্য সব উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী শিক্ষার্থী বা শিক্ষক হওয়ার জন্য তাকে বিশ্বমানের ক্যাটাগরির কয়েকটি পর্যায়ের সনদ দিতে হবে। যেন কওমি শিক্ষার্থী কেবল দাওরার সনদটি ভালো মানের পেয়েই ক্ষান্ত না হন। একই মানের এসএসসি, এইচএসসি ও ডিগ্রি বা অনার্সের সনদ তাকে সরবরাহ করতে হবে। যেন তিনি তাকমীলের সনদের পাশাপাশি এর আগের ধাপের সব সনদও মার্কসিটসহ হাতে পান। যা তাকে আরবী ও ইসলামী শিক্ষায় এমএর সমপর্যায়ের যে—কোনো প্রয়োজনে নিজের সনদ পেশ করার সুযোগ এনে দেয়। সরকারি বহু প্রতিষ্ঠান ইমাম, খতীব, ধমীর্য় শিক্ষক বা সাধারণ কর্মসংস্থানে একজন কওমি আলেমকেও অংশগ্রহণকারীরূপে পেতে পারে। আলমে ইসলামীর প্রতিটি উচ্চ শিক্ষাঙ্গন যোগ্য ও আগ্রহী কওমি সন্তানদের স্মার্ট কাগজপত্রসহ পেতে পারে। এজন্য আলহাইআতুল উলিয়ার সনদ হতে হবে বিশ্বমানের। আরবী ও ইংরেজি উভয় ভাষায় এবং ওয়ার্ল্ড ক্লাস মার্কসিট বা পয়েন্টসমৃদ্ধ। প্রশংসাপত্র ও ভালো ছাত্রের প্রয়োজনীয় সনদও হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের।
নিজেদের প্রচলিত শিক্ষা কারিকুলামের মধ্যে বছর বিভক্তি, কোরআন, হাদীস, ফিকহের সমন্বয়, সীরাত, তারীখ, আরবী আদব, ইনশা, বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সাধারণ বিজ্ঞান, পরিবেশ ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন সমন্বয় করে দেশীয় শিক্ষা কারিকুলামের বিশেষ দিকগুলি নিজেদের রুচি ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সিলেবাসভুক্ত করা যায়। সরকার, মন্ত্রণালয় বা মঞ্জুরি কমিশনের কোনো হস্তক্ষেপ থেকে নিজেরা যেমন নীতিগতভাবে দূরে থাকতে হবে, পাশাপাশি যুগোপযোগী শিক্ষার্থী বা আলেম তৈরির জন্য বাস্তব চাহিদাগুলো নিজেরাই পূরণ করে নিতে হবে। যেন মাঠের দাবি পূরণের ব্যর্থতার ফাঁক গলিয়ে বাইরের কোনো হস্তক্ষেপ আলহাইআতুল উলিয়ার ওপর চেপে না বসে।
আধুনিক জগতের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত, অভিজ্ঞ, পাশাপাশি বাংলাদেশের ত্রিমুখী শিক্ষা সম্পর্কে গভীরভাবে জানাশোনা এবং সবোর্পরি দেওবন্দের চেতনার ধারক—বাহক যোগ্য, গবেষক, শিক্ষাবিদ, শিক্ষানীতি—বিশারদ ব্যক্তিবর্গকে আলহাইআতুল উলিয়াসহ প্রতিটি বোর্ডের নীতি—নির্ধারণী জায়গায় কাজের সুযোগ করে দিতে হবে। যে ধরনের চতুর্মুখী ঝড়—ঝঞ্ঝা আগামী দিনগুলোতে আসছে তা মোকাবিলায় বর্তমান নেতৃত্বের হাতকে শক্তিশালী করার জন্য জাতির যোগ্যতর কওমি সন্তানদের মধ্য থেকে সেরাদের তুলে আনতে হবে। আল্লাহ আমাদের এই ঐতিহ্যবাহী দেওবন্দী শিক্ষাব্যবস্থাকে কায়েম ও দায়েম রাখুন।
—মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী